ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ জেলার সড়কে নাশকতা চলছে, নিহত ১৯ ড্রাইভার

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫

বিশ জেলার সড়কে নাশকতা চলছে, নিহত ১৯ ড্রাইভার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ আর বিভিন্ন স্থানে হরতালকে কেন্দ্র করে দেশের অন্তত ২০ জেলায় সড়ক-মহাসড়কে নাশকতা কমছে না। এসব জেলায় প্রতিদিনই গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়াসহ ভাংচুর, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। বগুড়াসহ একাধিক জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তায় চলছে যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহন। জামায়াত-শিবিরের তা-ব থেকে রেহাই পাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশু থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তকও এমনকি বোবা পশুও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া মানুষের ভিড় বাড়ছে। বাড়ছে কান্না, আহাজারি আর আর্তনাদ। কেন? কার স্বার্থে এমন সহিংসতা; অসহায় মানুষের কাছে প্রশ্ন এখন একটাই। মানুষ হত্যা করে রাজনীতি এটা কেমন গণতন্ত্র! এই প্রেক্ষাপটে জান ও মালের নিরাপত্তায় মহাসড়কে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করারও দাবি জানানো হয়েছে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে। এদিকে টানা অবরোধের নবম দিন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৭০টি যাত্রীবাহী বাস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে তিন শতাধিকের বেশি বাস। ভাংচুর করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে শতাধিক ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে চারজন চালক। দিনে পণ্য পরিবহনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করে ঢাকাসহ সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যোগাযোগ সচল হয়েছে। তবে আতঙ্কে যাত্রী সংখ্যা কম হওয়ার কথা জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মঙ্গলবার ঢাকা থেকে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। আন্তঃজেলা রুটে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় হরতালের কারণে বাস চলাচল কিছুটা বিঘœ ঘটে। সকল বাধা উপেক্ষা করে মালিকরা গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে প্রতিদিন পরিবহন সেক্টরে ৩০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতির নামে ধ্বংসাত্মক এই কর্মসূচীতে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সমর্থন নেই। সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সচল থাকলেও আক্রমণ হচ্ছে পরিবহনের ওপর। আমরা তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। তিনি জনস্বার্থে অবরোধ প্রত্যাহারে দাবি জানান। অবরোধ ও হরতালের নামে দেশের অন্তত ২০ জেলায় জামায়াত-শিবিরের তা-ব কমেনি। তারা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিদিন গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হতে হচ্ছে চালকদের। যাত্রীরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করছেন। বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, অবরোধের শুরু থেকে ২০টির বেশি জেলায় সবচেয়ে বেশি পরিবহনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে সোমবার তিনটি ট্রাক ভাংচুর করে পিকেটরারা। চাঁদপুরে মাধ্যমিক শ্রেণীর বইয়ে আগুন, ঝালকাঠিতে সদর থানার সামনে ট্রাকে আগুন, বরিশালে সাকুরা পরিবহনের বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে অবরোধকারীরা। এছাড়াও হবিগঞ্জের বাহুবলে ট্রাক জ্বালিয়ে দেয়া, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে আগুনে দগ্ধ হয়ে ট্রাকচালক নিহত, সাভারের হেমায়েতপুরে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে আগুন, কুমিল্লায় কাভার্ডভ্যানে আগুন, চুয়াডাঙ্গায় চালবাহী ট্রাকে আগুন, নড়াইলে বাসে, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জসহ জয়পুরহাটে বাস এবং ট্রাকে নাশকতার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। এছাড়াও গাজীপুরে কালিয়াকৈর, বগুড়া, গাইবান্ধা, নোয়াখালী, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা নাশকতা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে রংপুরের মিঠাপুকুরে অবরোধকারীদের বাসে দেয়া আগুনে এক শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে যাত্রী নিয়ে খলিল পরিবহনের একটি বাস ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিল। রাত ১টার দিকে মিঠাপুকুরের জায়গীরহাটে শাপলা হিমাগারের কাছে পৌঁছলে ব্যারিকেড দিয়ে বাসটি থামানো হয়। এরপর পেট্রোল ঢেলে বাসটিতে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এতে ঘটনাস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে দুজন নারী এবং দুই থেকে তিন বছরের একটি শিশু রয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে নোয়াখালীতে অবরোধকারীদের ইটের আঘাতে অটোরিক্সাচালক নিহত হয়েছেন। অবরোধের মধ্যে সারাদেশে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে মহাসড়কে নিরাপত্তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে র‌্যাব প্রহরায় যানবাহনও কিছু ছেড়ে যায়। বাস মালিকরা বলছেন, মহাসড়কের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে নিরাপত্তা টহল বাড়ানো হলেও সারাদেশে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হবে। বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব জনকণ্ঠকে বলেন, সমিতির তালিকাভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান সারাদেশে চলাচল করে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার গাড়ি চলছে। আতঙ্কের কারণে মালিকদের সবাই গাড়ি চালাতে আগ্রহী নন। একারণে এই সেক্টরে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্বিচারে গাড়িতে আগুন ও ভাংচুর করা হচ্ছে। মহাসড়কে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা না হলে গাড়ি চালানো কঠিন হবে। যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে বিএনপির ডাকা হরতালকে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন পরিবহন মালিকরা। তাঁরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই হরতাল আহ্বান করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অবরোধের পরও হরতালকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদিকে মহাসড়কে নাশকতা রোধে কুমিল্লায় পাঁচ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয় মঙ্গলবার। বুধবার সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। বুধবার সকাল থেকে নোয়াখালী, পাবনা, ইশ্বরদী, রংপুর, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। খুলনা বিভাগেও হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালকে কেন্দ্র করে এসব জেলায় নতুন করে নাশকতা হওয়ার আশঙ্কা পরিবহন নেতাদের। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরোধের পাশাপাশি দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অবরোধের নবম দিনে রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকেল থেকে প্রায় সব বাসই বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের শ্যামলী পরিবহনের সহকারী ব্যবস্থাপক কামাল বলেন, যাত্রী কম। এরপরও বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলায় বাস ছেড়ে যাচ্ছে। অবরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে দূরপাল্লার বাসগুলো ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্যান্য দিনে বেলা ১১টা পর্যন্ত তাদের প্রায় বাস টার্মিনাল ছেড়ে যায়। কিন্তু অবরোধের কারণে মঙ্গলবার মাত্র তিনটি বাস টার্মিনাল ছেড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামগামী পরিবহন নিউ ঈগলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রদীপ বলেন, অবরোধের কারণে কিছুটা সমস্যাতো হচ্ছেই। সকালে যাত্রীই পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, হরতাল বা অবরোধ না থাকলে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে নিউ ঈগল পরিবহনের প্রায় ২০টি বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত মাত্র চারটি বাস টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। গাড়ি চালানোর বিষয়ে সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ সব রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক আছে। সকাল থেকে কোথাও কোন অঘটনের খবর আসেনি। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন আছে একথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আরও পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হলে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালানো সম্ভব হবে।
×