ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাদের দৃষ্টি আকর্ষণে রিয়াজ রহমানের ওপর এ হামলা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫

কাদের দৃষ্টি আকর্ষণে রিয়াজ রহমানের ওপর এ হামলা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জটিল অঙ্কের আবর্তে দেশের রাজনীতি! আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানের সুযোগে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক কূটনীতিক রিয়াজ রহমানের প্রাণনাশের চেষ্টা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে আরও জটিল করে তুলেছে। হঠাৎ করেই কেন এ হামলা, কারা করেছে এবং কেনই বা রিয়াজ রহমানকে বেছে নেয়া হয়েছেÑ ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। এ হামলাকে প্রধান দুই দল পরস্পরকে দোষারোপ করলেও রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন অন্য কথা। তাঁদের মতে, ম্রিয়মান ও প্রায় অকার্যকর চলমান অবরোধ কর্মসূচীকে চাঙ্গা এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায় অর্থাৎ ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মারার কৌশল থেকেই রিয়াজ রহমানকে হামলার জন্য বেছে নিয়েছে তৃতীয় পক্ষ। আর এই তৃতীয় পক্ষ যে জামায়াত-শিবির কিংবা বিএনপির সমর্থনপুষ্ট সাম্প্রদায়িক কোন অপশক্তি, আকার-ইঙ্গিতে এবং টেবিলের আলোচনায় সেটিই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হচ্ছে। রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে লাভ-লোকসানের হিসেব চলছে রাজনৈতিক মহলে। বিএনপি বলছে, চলমান আন্দোলনকে ভয় দেখাতে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই সরকারই রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা খালেদা জিয়ার নীলনকশারই অংশ। এ হামলা বিএনপিই করেছে। এ দু’দলের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলার মোটিভ বা ধরন দেখলেই স্পষ্ট হবে হত্যার উদ্দেশ্য নয়, আহত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল এবং রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই আন্দোলনকারীদেরই কোন অংশ কিংবা জামায়াত এ হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। প্রায় ভেস্তে যেতে বসা অবরোধের কথিত আন্দোলনকে আরও কিছুদিন টেনে নিয়ে যেতেই তৃতীয় পক্ষটি এ ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপিকে দায়ী করে বলেন, জনগণ অবরোধ প্রত্যাখ্যান করে স্বাভাবিক অবস্থান করছেন। মানুষ বিএনপি-জামায়াতের চোরাগোপ্তা হামলা উপেক্ষা করে যখন সবাই স্বাভাবিক জীবনে চলে এসেছে, সেই সময় খালেদা জিয়া নীলনকশা শুরু করেছে। রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা এ নীলনকশার একটি অংশ বলে মনে করি। ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে খালেদা জিয়া এখন লাশের রাজনীতি শুরু করেছেন। একইদিন বিএনপির পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী পাল্টা আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বলেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করার জন্য সরকার গুপ্তঘাতক নামিয়েছে। তাঁর ভাষায়, জনগণের তুমুল আন্দোলনের চাপে দিশেহারা সরকার শেষ বিষাক্ত ছোবল দেয়ার জন্য গু-াবাহিনীদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছে। এরই নির্মম শিকার হয়েছেন দেশের পেশাদার কূটনীতিক ও বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমান। এ ঘটনার জন্য সরকারই দায়ী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমানের ওপর হামলাকারীরা ছাড় পাবে না। এটা সভ্য জগত। একটা ঘটনা ঘটে যাবে, আমরা কিছু করব না তা হয় না। তদন্ত করে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে কারা এ হামলা ঘটিয়েছে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে দোষীদের অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের নামে ভয়াল সহিংসতা, নাশকতা এবং মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ইতোমধ্যেই দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা কিংবা সমর্থন আদায়েও ব্যর্থ হয়েছে আন্দোলনকারীরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর বলে পরিচিত বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোরও সামান্য সমর্থন আদায়েও ব্যর্থ হয় বিএনপি ও জামায়াত। এমন যখন দেশের বাস্তবতা, তখনই মঙ্গলবার রাতে রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনাটি ঘটে। তাঁদের মতে, রিয়াজ রহমান বিএনপির রাজনীতিতে বড় কোন ফ্যাক্টর না হলেও সাবেক কূটনীতিক-আমলা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে রিয়াজ রহমানের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। তাই রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা হলে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে জামায়াত-বিএনপি। এমনই সুদৃঢ় পরিকল্পনা থেকেই রিয়াজ রহমানকে ‘বলির পাঠা’ হিসেবে বেছে নেয়া হতে পারে। এদিকে এ হামলার কারণ অনুসন্ধান এবং হামলাকারীদের গ্রেফতারে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এটি যে সুপরিকল্পিত হামলা এতে কোন সন্দেহ নেই। যদি বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমানকে হত্যারই উদ্দেশ্য থাকতো হবে হামলাকারীরা কাছ থেকে শুধু তাঁর পা ও কোমরে গুলি করে চলে যেত না। এতেই স্পষ্ট হয় যে, বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে রাখতে এবং নতুন করে আন্দোলনকে চাঙ্গা করার টার্গেট থেকেই তৃতীয় পক্ষ এ ঘটনাটি ঘটিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁদের সন্দেহের তীর জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের দিকে। আর ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, রিয়াজ রহমান এখন সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত। এবং তার দেহে কোন ধাতব পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাটি নিয়ে খোদ বিএনপির মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ঘনিষ্টদের কাছে অনেক বিএনপি নেতাই বলেছেন, হামলা হলে রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর বলে পরিচিত বিএনপি নেতাদের ওপর হামলা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। কিন্তু বিএনপির মাঠের রাজনীতিতে কার্যত নিষ্ক্রিয়, যিনি শুধু খালেদা জিয়াকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেনÑ সেই পেশাদার কূটনীতিক রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনা সাধারণভাবে নিতে পারছেন না। এ ঘটনার নেপথ্যের অঙ্ক মিলিয়ে বিএনপির অনেক ত্যাগী নেতাও এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে দলেরই একটি পক্ষ কিংবা সুযোগ-সন্ধানী জামায়াতের ঘৃণ্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁরাও এমন হামলার শিকার হতে পারেন। কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও বিএনপির উদারপন্থী বলে খ্যাত বড় এ অংশটিও রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ওপরই প্রাণঘাতি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি সমূলে শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ অনেক জনপ্রতিনিধিকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার উদ্দেশে একাধিকবার চেষ্টা চালানো হয়েছে। আর এসব হামলাই যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্চ মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হয়েছে, পরবর্তীতে তদন্তে তা বেরিয়ে এসেছে। সেই পর্যালোচনা অনুযায়ী, তিন মেয়াদে ১১ বছর ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আর এ ১১ বছর মেয়াদে একজন বিএনপির সিনিয়র নেতার ওপরও বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলের মতো হামলা বা হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এমন একাত্তরের শত্রু জামায়াতের বড় কোন নেতাকেও হামলায় জীবন দিতে হয়নি। নানা মামলা ও সহিংসতা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির অনেক নেতা কারাভোগ বা দু’তিনজন নেতার হদিস না মিললেও বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতাদের ওপর কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি। বরং গত এক বছরে বিরোধী দলের আসনটি হারালেও খালেদা জিয়াসহ বিএনপির বড় বড় নেতারা সরকার থেকে অধিক নিরাপত্তাই পেয়ে আসছেন। এসব উদাহরণ তুলে ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ গুলি করে রিয়াজ রহমানকে আহত করে চলমান অবরোধের আন্দোলনকে চাঙ্গা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিএনপিরই ভেতর থেকেই কিংবা জামায়াত-শিবির বা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কোন অংশ সুপরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। বিএনপি ও জামায়াতের কোন কোন নেতা এ হামলার ঘটনায় সরকারকে এবং আকার-ইঙ্গিতে সরকারী এজেন্সির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করলেও রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের মতে, সরকার কেন রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করতে চাইবে। সরকার শক্ত হাতেই এবং নানা কৌশলে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচী ব্যর্থ করে দিয়ে দেশের পরিস্থিতিকে প্রায় স্বাভাবিক করে এনেছে। চোরাগোপ্তা হামলা, সহিংসতা ও নাশকতা চালালেও রাজপথে দেখা মেলে না বিএনপি কিংবা জামায়াত নেতাকর্মীদের। দেশের এমননি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার কখনই চাইবে না বিরোধী পক্ষের হাতে বড় কোন ইস্যু তুলে দিতে। বরং বিএনপি কিংবা জামায়াতই এ ঘটনা ঘটিয়ে সরকারকে পাল্টা চাপে ফেলার চেষ্টা করছে বলেই তাঁরা মনে করছেন। বুধবার খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু মানুষকে পুড়িয়ে মারা, এটা কী ধরনের আন্দোলন জানি না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কথা চিন্তা করেই মানুষকেই যদি মারা হয়, মানুষকেই যদি পঙ্গু করে দেয়া হয়, একেকটা পরিবারকে যদি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হয়, তাহলে কার জন্য রাজনীতি? বরং আমি এটাই বলব, এ ধরণের কর্মকা- থেকে বিরত থাকুন। আর তা না হলে আমাদের আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
×