ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুষ্প্রাপ্য খেজুরের রস

শীত-পিঠা পায়েস পাটালি গুড় এখন শুধুই স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১২ জানুয়ারি ২০১৫

শীত-পিঠা পায়েস পাটালি গুড় এখন শুধুই স্মৃতি

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ শীতকাল মানে হাড়কাঁপুনে ঠাণ্ডা। আর মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম। এজন্য এক সময় তীব্র শীতের মাঝেও খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতেন গাছিরা। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ক্রমবর্ধমান মানুষের বাড়ি-ঘর নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ক্রমেই খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। গত কয়েক বছর পূর্বেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালি গুড় বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে গত দু’তিন বছর ধরে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। খেজুর রস দিয়ে শীত মৌসুমে পিঠা ও পায়েস তৈরির প্রচলন থাকলেও বরিশালে শীতকালীন খেজুর গাছের রস এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের কিছু কিছু এলাকায় এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর গাছ থাকলেও সঠিকভাবে তা পরিচর্যা না করা, নতুন করে গাছের চারা রোপণ না করা এবং গাছ কাটার পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। এছাড়া একশ্রেণীর অসাধু ইটভাঁটির ব্যবসায়ীরা জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও শীত পড়ার শুরুতেই বরিশালের সর্বত্র পেশাদার খেজুর গাছির চরম সঙ্কট পড়ে। তারপরও কয়েকটি এলাকায় শখের বশত গাছিরা নামেমাত্র খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ওইসব গাছিরা সকাল-বিকেল দুই বেলা রস সংগ্রহ করছেন। কবি ও সাহিত্যিক শিকদার রেজাউল করিমের মতে, প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাস আর ঘন কুয়াশার চাদর, হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের। এ সময় মৌসুমী খেজুর রস দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শুরু হতো শীতের আমেজ। শীত যত বাড়তে থাকত খেজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ত। শীতের সঙ্গে রয়েছে খেজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। এ সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হতো পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালি তৈরির ধুম। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও বাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যেত। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজা পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের তো জুড়িই ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। সূত্রমতে, প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ আর গুড়ের জন্য এক সময় এ অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। অনেকে শখেরবশে খেজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বলে থাকতেন। ওই সময় শীতের মৌসুমে খেজুর রসের নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠত গ্রামীণ জনপদ। খেজুর রস দিয়ে গৃহবধূদের সুস্বাদু পায়েস, বিভিন্ন ধরনের রসে ভেজানো পিঠা তৈরির ধুম পড়ত। রসনা তৃপ্তিতে খেজুরের নলেন গুড়ের পাটালির কোন জুড়ি ছিল না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষ শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঠা-া খেজুর রস না খেলে যেন দিনটাই মাটি হয়ে যেত। কিন্তু ইটভাঁটির আগ্রাসনের কারণে আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ইটভাঁটির খেজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ইটভাঁটির মালিকরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেজুর গাছ। গত কয়েক বছর ধরে ইটভাঁটির জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছকে ব্যবহার করায় বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চল থেকে দ্রুত খেজুর গাছ ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ফলে এ জনপদের মানুষ এখন খেজুর রসের মজার মজার খাবার অনেকটাই হারাতে বসছে। শখের বশত প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিরা বলেন, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল আসলেই অযতেœ-অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীণ জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায়। বর্তমানে এসব অঞ্চলে প্রতি হাড়ি খেজুর রস এক থেকে দেড় শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তারা আরও বলেন, খেজুর গাছ রক্ষায় বন বিভাগের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু আরব্য উপনাস্যের গল্পে পরিণত হতে চলেছে। জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এ খেজুর রসের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেজুর গাছের অস্তিত্ব। আর সে জন্য যথাযথভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাঁটিসহ যে কোন বৃক্ষ নিধনকারীদের হাত থেকে খেজুর গাছ রক্ষা করতে হবে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ইতোমধ্যে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশের পরিত্যক্ত স্থানে কৃষকরা পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর গাছ রোপণ করা হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
×