ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনে তারেকের নেতৃত্বে প্রোপাগাণ্ডা উইং বিএনপির

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

লন্ডনে তারেকের নেতৃত্বে প্রোপাগাণ্ডা উইং বিএনপির

শংকর কুমার দে ॥ ‘যদি একটি বড় মিথ্যাকে (বিগ লাই) বার বার বলা হয়, তবে সত্য বলে মনে করে এটা মানুষজন বিশ্বাস করবে’- গোয়েবেলসীয় থিউরির এই কায়দায় বিএনপির অপপ্রচারের পথ বেছে নেয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিএনপির পক্ষ থেকে গোয়েবেলসীয় থিউরির অপপ্রচারের জন্য উইং খোলা হয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। লন্ডনে স্থাপিত অপপ্রচার উইংয়ের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তাদের অপপ্রচার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশে প্রচার করার জন্য বাছাই করা হয়েছে তার একান্ত বিশ্বস্ত অনুগতদেরকে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের বড় ও বিখ্যাত রাজনীতিকদেরকে টার্গেট করেছে তারা। জাল স্বাক্ষর, ভুয়া বিবৃতি, ফোন কেলেঙ্কারী, মিথ্যা ও কল্পিত সভা-সেমিনারের নামে বক্তব্য পাঠিয়ে অপপ্রচার করা হবে সরকারের বিরুদ্ধে। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের ছক কষতে গোয়েবেলসীয় কায়দার মিথ্যাচারের পথ বেছে নিয়েছে বিএনপি। এজন্য বিরাট অঙ্কের টাকার ফান্ড নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। অনুসন্ধানে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এমন এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিএনপি এখন অনুসরণ করছে, জার্মানীর নাৎসী স্বৈরশাসক এড্লফ হিটলার তার মন্ত্রী পরিষদে একটি প্রোপাগা-া মিনিস্ট্রি ও জোসেফ গোয়েবেলসকে এই মিনিস্ট্রির মন্ত্রী নিয়োগ করার ঘটনার প্রক্রিয়াটি। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলারের শাসনামলের গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে বেছে নেয় তারা গোয়েবেলসীয় কায়দার মিথ্যাচারকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার কাছে জার্মান পরাজিত হওয়ার পর হিটলার ও তার প্রোপাগাণ্ডা মন্ত্রী গোয়েবলসে দু’জনেই সপরিবারে আত্মহত্যা করে গোয়েবলেসীয় কায়দায় মিথ্যা অপপ্রচার করার করুণ পরিণতি ভোগ করেন। ভারতের বিজেপি প্রধান অমিত শাহ টেলিফোন করে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জাল করে বিবৃতি ছাপানোর ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির গোয়েবেলসীয় কায়দায় মিথ্যাচারের আরেকটি করুণ পরিণতির ঘটনার যোগসূত্র পেয়েছে বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানান, সরকারের ওপর বিদেশীদের চাপ সৃষ্টি করতে গোয়েবলসীয় কায়দায় অপপ্রচারের কৌশলটি হচ্ছে, বাংলাদেশে যেমন অখ্যাত, অপরিচিত অনলাইনসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম আছে, তেমনি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের সেই ধরনের অনলাইনসহ সংবাদ মাধ্যমে ভুয়া, মিথ্যা, কল্পিত খবর ছাপিয়ে তা ঢাকার সংবাদ মাধ্যমে পাঠিয়ে প্রচার করার ব্যবস্থা করার কৌশল নেয়া হয়েছে। ভুয়া ও মিথ্যা বক্তব্য বিবৃতি ছাপানোর জন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিকদের স্বাক্ষর টেম্পারিং বা জাল করে সংবাদ মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে প্রতারণার কবলে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশের মাটিতে কোন সভা সেমিনার না করেই প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে ছাপানোর ব্যবস্থা করা। তারপর টেলিফোন কেলেঙ্কারি করার কৌশলও নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণার মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভারতের বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্র সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বিবৃতি ছাপানোর ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে উদ্ঘাটন করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেস সদস্যের স্বাক্ষর-সংবলিত বিবৃতি জাল করে লন্ডনের একটি পত্রিকার অনলাইনে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমও তা প্রকাশ করে। পাঠানো হয় ভারতের সংবাদ মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সভার পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস ও র‌্যাংকিং সদস্য এলিয়ট ইঙ্গেল এ ঘটনার পর এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁরা এ ধরনের কোন বিবৃতি দেননি। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নামে ভুয়া বিবৃতি তৈরি করে কোন দলের ব্যবহার করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা। লন্ডনের যেই পত্রিকাটি খবর ছাপিয়েছে তাঁরা তা প্রত্যাহার করে বলেছে, তাঁরা জালিয়াতির শিকার। জালিয়াতির শিকার পত্রিকাটিকে ওই ভুয়া বিবৃতি সরবরাহ করেছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জ্যেষ্ঠ সহকারী হুমায়ুন কবির। প্রতিবেদনের পরের অংশেই তারেকের সহকারী হিসেবে হুমায়ুন কবিরের নামও স্থান পেয়েছে। ভুয়া বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশ না করতে আদালতের নির্দেশনা এবং গণমাধ্যমের ওপর অবৈধ সেন্সরশিপ আরোপের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা বলে মিথ্যাচার করা হয়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জ্যেষ্ঠ সহকারী হুমায়ুন কবীরের পাঠানো একটি ডকুমেন্টের ভিত্তিতে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস ইউকে ৮ জানুয়ারি ভুয়া খবর প্রকাশ করে। ভুয়া বিবৃতি সরবরাহকারী লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জ্যেষ্ঠ সহকারী হুমায়ুন কবিরের এ ধরনের মিথ্যা অপপ্রচারের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কার্যত গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহকারী হুমায়ুন কবীর ছাড়াও ভুয়া বিবৃতি প্রচারের সঙ্গে জড়িত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিশেষ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বৈদেশিক দূত জাহিদ এফ সরদার সাদীও। জাহিদ এফ সরদার সাদী মিথ্যাচারের আরেকটি নমুনা হচ্ছে, গত ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে (৬ জানুয়ারি) নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় কংগ্রেস সদস্য হাকিম জেফরি বিষয়টি হাউসে উত্থাপন করেন বলে জানিয়েছিলেন তাও মিথ্যা ও ভুয়া। বিএনপির বৈদেশিক দূত এবং বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এফ সরদার সাদী আমেরিকার ফ্লোরিডা ও এ্যারিজোনায় একাধিক প্রতারণার মামলায় বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন বলে জানতে পেরেছে গোয়েন্দা সংস্থা। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ গত বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ফোন করে তাঁর অসুস্থতার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন বলে বিএনপি তথ্য দিয়েছিল তাও সঠিক নয় বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। অমিত শাহ্ কিংবা তাঁর অধীনস্থ সংশ্লিষ্ট কারও কাছ থেকে এর সত্যতা নিরূপণ না করে অজ্ঞাতনামা কূটনৈতিক বা অন্যান্য সূত্রের বরাত দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টার জন্য এমন মিথ্যাচার করা খুবই অনভিপ্রেত বলে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন। তা সত্ত্বেও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিজেপি সভাপতির কথা হয়েছে, এটাই নির্ভেজাল সত্য। তিনি বলেন, ‘অমিত শাহ্র সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কথা হয়নি বলে যে কয়েকটি গণমাধ্যম বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করছে, ক্ষমতাসীন মহল সবদিক থেকে ব্যর্থ হয়ে এ নানামুখী মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দেশবাসীকে এ মিথ্যাচার থেকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান রুহুল কবির রিজভী। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, লন্ডনে বসে তারেক রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজাকার, পাকবন্ধু ইত্যাদি ধরনের যেসব কটূক্তি ও কুরুচিপূর্ণ মিথ্যাচার করে চলেছেন তাও সরকারের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত গোয়েবেলসীয় কায়দায় অপপ্রচার। এ অপপ্রচারের শুরুটা তারেক রহমানের পিতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার মধ্য দিয়ে। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে বার বার একটি বড় মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে বিশ্বাসযোগ্য করার গোয়েবেলসীয় কায়দায় অপপ্রচার করেছে। ইতিহাস বিকৃতি করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করে বক্তব্য দিচ্ছে। এজন্য বিরাট অঙ্কের টাকা ঢালা হচ্ছে। লন্ডনে বসে তারেক রহমান যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার করানোর জন্য উইং খুলেছেন। এসব দেশের রাজনীতিকদেরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালানোর জন্য লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। তারেক রহমানের বিশ্বস্ত অনুচর যারা তাদের দিয়েই বিদেশের অখ্যাত, অপরিচিত অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে আবার তা ঢাকায় পাঠিয়ে প্রকাশ করাচ্ছে। এ ঘটনা যে এখানেই শেষ তা নয়, আরও ঘটতে পারে। তবে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে অর্থের উৎস কোথায়, কারা, কিভাবে, গোয়েবেলসীয় কায়দায় অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করছে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
×