ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারাত্মক দগ্ধ ওরা ৪- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বার্ন ইউনিটে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

মারাত্মক দগ্ধ ওরা ৪- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বার্ন ইউনিটে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ওরা চারজন। রিক্সাচালক পঞ্চাশোর্ধ অমূল্য চন্দ্র বর্মন, প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম (৩৩), মসজিদের মোয়াজ্জিন আবদুল গফুর ও খাদেম মিজানুর রহমান। অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমায় ওরা মারাত্মক দগ্ধ। ওদের সারা শরীরে পোড়া ক্ষত চিহ্ন। কারও শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। কারও মুখ ঝলসে গেছে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ওরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। হাসপাতালের বেডে ওরা কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওদের খোঁজ কেউ নেয়নি। দগ্ধদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, অবরোধকারীদের আগুনে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। ওদের সংসার এখন চালাবে কে? এমনকি হাসপাতালের খরচও নিজেদেরই বহন করতে হচ্ছে। তাদের অভিযোগ সরকারের কেউই তাদের দেখতে আসেননি। এখানকার নার্সরা ঠিকমত রোগীর খোঁজখবর নিচ্ছে না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যাদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, তাদের বাঁচানো খুবই দুঃসাধ্য। শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ঘুরে দেখা গেছে, বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ৪ নম্বর বেডে নিথর পড়ে আছেন অমূল্য বর্মন। সারা শরীরে পোড়া ক্ষত। কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাঁর বেডের শিয়রে বসে আছেন বন্ধু জাহিদুল ইসলাম। তিনিও ওই বাসে ছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু বন্ধু অমূল্য বাসে আটকাপড়ে মারাত্মক দগ্ধ হন। অমূল্য বর্মণের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের ময়দানদিঘি ইউনিয়নের কাদেরপুর গ্রামে। বড় ছেলে নিতাই (১২), মেজ ছেলে রতন (৭) আর ছোট ছেলে জয় (২)। স্ত্রী রত্না এই তিন সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। জীবিকার সন্ধানে গত ৬ বছর অমূল্য সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় রিকশা চালান। আহতের বন্ধু জাহিদুল জানান, শুক্রবার রাতে ৫ বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি যাওয়ার। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে অমূল্য ও তার ৪ বন্ধু মিলে গাবতলী যাওয়ার উদ্দেশে সায়েদাবাদ থেকে ৮ নম্বর বাসে ওঠেন। সাতটার দিকে বাসটি কাওরান বাজার সিগনাল অতিক্রম করে তেজগাঁও মহিলা কলেজের সামনে পৌঁছে। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে দুই যুবক বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে। এ সময় চার বন্ধু বাসের জানালা ভেঙ্গে চলন্ত বাস থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ি। কিন্তু অমূল্য বের হতে পারেনি। বাস ফেলে চালকও দৌড়ে পালায়। মুহূর্তে বাসে আগুন ধরে যায়। অমূল্য বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করেন। ততক্ষণে সব শেষ। অমূল্যের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এসে বাসের আগুন নিভিয়ে অমূল্যকে উদ্ধার করে। তেজগাঁও থানার এএসআই খোরশেদ আলম তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। অমূল্যের স্বজনরা অভিযোগ করেন, যারা অমূল্যের সংসার তছনছ করে দিল, ভগবান ওদের বিচার করবে। বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, ‘অমূল্যর শরীর তুলনামূলক কম পুড়েছে। কিন্তু তাঁর শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’ গাড়িচালক আবুল কালামের শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া ক্ষত। হাত-পা নাড়াতে পারছে না। দু’হাতে গোটা কয়েক ক্যানোলা। যন্ত্রণায় বার বার ছটফট করছে। বার বার বিড় বিড় করে বলছে বাঁচবে তো। মাকে অনেকদিন দেখেনি। খবর পেয়ে দুপুরে বয়োবৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম ও চাচাত বোন জাহানারা হাসপাতালে ছুটে আসেন। বার্ন ইউনিটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যু সন্ধিক্ষণে আবুল কালাম। যন্ত্রণায় ছটফট করে মাগো বলে উঠছে আবুল কালাম। কষ্ট ও যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে গাড়িচালক আবুল কালাম বলছিল ‘মায়া ভাইরে (মন্ত্রী মায়া চৌধুরী) বইলেন, আমি আর বাঁচমু না। আমারে যেন একটু দেইখা যায়। আর এহানকার ডাক্তারগো যেন একটু কইয়া যায় আমার যতœ নিতে।’ শুক্রবার রাত এগারোটার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের সেলিম কমিউনিটি সেন্টারের সামনে পার্কিং অবস্থায় একটি প্রাইভেটকারে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। স্থানীয়রা পরে গাড়ির আগুন নিভিয়ে বের করে আনেন চালক মোঃ আবুল কালামকে। কিন্তু ততক্ষণে আবুল কালামের শরীর অনেকটা পুড়ে গেছে। তার শরীরের এক তৃতীয়াংশ আগুনে ঝলসে যায়। বার্ন ইউনিটে আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, আবুল কালামের শরীরের ৩৩ ভাগ পুড়ে গেছে। তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাই তার ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আহত কালামের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, সবকিছু আমাদেরই কিনতে হচ্ছে। এমনকি সুঁই পর্যন্তও বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালে কেউ খোঁজ খবর নিচ্ছে না। দগ্ধ আবুল কালামের বাবার নাম মৃত আব্দুল হক। বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া থানার রাংতা গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আবুল কালাম সবার ছোট। তার মেজ ভাই আবু তালেব কৃষিকাজ করেন। আর বড় ভাই ইব্রাহিম ঢাকায় গাড়ি চালান। উল্লেখ্য, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের ভাতিজা নাদিম চৌধুরীর গাড়িচালক এই আবুল কালাম। অন্যদিকে শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে অবরোধের দিনে মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ এলাকায় অবরোধকারীরা একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁেড় মারে। এতে বাসে আগুন ধরে যায়। মিজানুর রহমান (৩০) ও আবদুল গফুর (৩২) নামে দুই যাত্রী মারাত্মক দগ্ধ হন। কামরাঙ্গীর চরের পশ্চিম নবীনগরের আল হোসেনিয়া জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন গফুর ও একই মসজিদের খাদেম মিজানুর রহমান। মিজানুর ও গফুর জানান, মসজিদের ইমাম রুহুল আমিনকে গাবতলীতে বাসে তুলে দিয়ে তারা ফিরছিলেন। পথে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ কবরস্থান সংলগ্ন রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বাসে আরও ৬/৭ যাত্রী ছিল। এতে মিজানুর রহমানের দুই হাত ও দুই পা এবং গফুরের দুই পা ও এক হাত পুড়ে গেছে। ঢামেক ক্যাম্প পুলিশ ইনচার্জ মোজাম্মেল হক জানান, অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাত একটার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া গত সোমবার বিকেলে অবরোধের ডাক দেয়ার পর থেকেই ঢাকায় বিক্ষিপ্তভাবে যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটছে। শনিবার রাজধানীতে দশটি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। আগের দিন শুক্রবারও দশটি যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে। দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনজন। তার আগে মঙ্গলবার রাজধানীতে আগুন দেয়া হয় ছয়টি গাড়িতে। বুধবার সারা দিন পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকলেও সন্ধ্যার পরপরই চারটি বাস পোড়ানো হয়। বৃহস্পতিবার আগুন দেয়া হয় তিনটি বাসে। এ নিয়ে পাঁচদিনে প্রায় দশজন দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়।
×