ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও এক নায়ক সুলভ মনোভাবের কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি

রাজাপাকসের হারের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

রাজাপাকসের হারের নেপথ্যে

শ্রীলঙ্কার বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের পরাজয় এক অসাধারণ ঘটনা। কারণ এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে তিনি প্রভূত সুবিধা ভোগ করেছিলেন। তিনি নির্ধারিত সময়ের দু’বছর আগেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। দেশের প্রকাশ্য স্থানগুলো ছিল তার ছবিতে সাজানো। তার নির্বাচনী সমাবেশগুলো ছিল ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ। সেখানে তিনি আশপাশের গ্রামগুলো থেকে বাসে করে আনা জনতার সমুদ্রে ভাষণ দেন। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মৈত্রীপালা সিরিসেনা স্টেডিয়াম ভাড়া নিতে অসমর্থ হয়ে খালি জায়গাগুলোতে লোকজনের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। রাজাপাকসে প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে তার নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে গত কয়েক বছর ধরে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কোন ব্যক্তি কতবার প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন, সেই সম্পর্কিত সীমা তুলে দিতে সংবিধান সংশোধন করেন। আর তিনি তার এ কাজে বাধা দিয়েছিলেন সপ্রীমকোর্টের এমন এক বিচারপতিকে বরখাস্তও করেন। কিন্তু তিনি অনুকূল পরিস্থিতিতেই তা করেছিলেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহ দমনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল সবার ওপরে। ওই বিজয়ের পর শ্রীলঙ্কা পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন থেকে উপকৃত হয় এবং দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ অঞ্চলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। এতে ভোটাররা তার ক্ষমতা সুসংহত করার পদক্ষেপ মেনে নেবেন বলে ধারণা করেন তিনি। বৃহস্পতিবারের নির্বাচন রাজাপাকসের ওই অনুমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলে কলম্বোর সেন্টার ফর পলিসি অন্টারনেটিভসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পি. সরবনসুত্তু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মূলত ভোটাররা এক নায়কসুলত মনোভাব,কুশাসন ও পরিবারতন্ত্র থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। রাজাপাকসের আগাম নির্বাচন চাওয়ার সিদ্ধান্ত শক্তির প্রকাশ নয় বরং তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের স্বীকৃতিই ছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রদের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছিল। জ্বালানি ও অন্যান্য আমদানি কারা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিও রাজাপাকসের জনপ্রিয়তা ক্ষুণœ করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তার পরিবারের সদস্যরা সরকারের উচ্চপদগুলোতে আসীন হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের ধনী করে তুলেছেন। মৈত্রীপালা সিরিসেনা ও রাজাপাকসের পক্ষত্যাগীরা তাদের প্রচার অভিযানে এ অভিযোগ তুলেছিলেন। তামিল সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজাপাকসের অস্বীকৃতি এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তাকে অনেক নির্বাচনী এলাকার ভোট থেকে বঞ্চিত করে। দেশের উত্তরাঞ্চলের জাতিগত আমিল-অধ্যুষিত সাবেক যুদ্ধ এলাকা এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ভোট সিরিসেনার বিজয়ে অন্যতম বড় ভূমিকা রাখে। এক খবরে বলা হয়, তামিলদের প্রভাবিত কিলিনেয়চ্ছিতে সিরিসেনা প্রদত্ত ভোটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পান। কিন্তু ক্ষমতার এ হাত-বদল শ্রীলঙ্কায় উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার জন্ম দিতে পারে। সিরিসেনা রাজাপাকসের প্রবর্তিত শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাকে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী জাতিগত ও মধ্যডানপন্থী দলগুলোর এক কলহপ্রবণ কোয়ালিশনের নেতৃত্ব দিতে হবে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে রাজাপাকসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত হবে। সাবেক কূটনীতিক জয়তিলেকা বৃহস্পতিবার বলেন, কয়েক মাসের মধ্যেই কোন ধরনের গোলযোগ দেখা দেবে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলগুলোর পরিবর্তন আনার কোন পরিকল্পনা অবশ্যই রয়েছে এবং অস্থিরতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র বিজয়ীর পক্ষেই যাবে। অস্থিরতা যদি আদৌ দেখা দেয়, তা হলে সেটি পরেই দেখা দেবে, যখন প্রেসিডেন্টের শাসন বিলুপ্ত করা হবে এবং অনেকগুলো দলই ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। নিউইয়র্কের রাজনৈতিক ঝুঁকি বিষয়ক কনসাল্ট্যান্সি প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক সাশা রিসার কোসিটস্কি বলেন, শ্রীলঙ্কার সরকারী নীতির ক্ষেত্রে কি পরিবর্তান ঘটবে, তা অনিশ্চিত রয়ে গেছে। কারণ সিরিসেনার নেতৃত্বে সমবেত হওয়া বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী, মার্কস বাদী ও মধ্যডানপন্থী রাজনীতিকরা প্রেসিডেন্টের বিরোধী হওয়া ছাড়া অন্য কোন বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ নন। Ñগার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস।
×