ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সুখ অসুখের এই ধরণী

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সুখ অসুখের এই ধরণী

বিশ্বের অন্যতম সেরা এক জরিপ সংস্থার মতে, ফিজিয়ান রাই এবার শ্রেষ্ঠ সুখী জাতি। ৯৭ শতাংশ ফিজিয়ানরা জানিয়েছেন তাঁরা সুখী ও আশাবাদী। অস্ট্রেলিয়ার খুব কাছের এই দেশটি নিয়ে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। অভিবাসী হয়ে সিডনি আসার আগে ফিজিকে জানতাম ক্যু ক্যু ল্যান্ড বা অভ্যুত্থানের দেশ হিসেবে। আমাদের যৌবনে রামবুকা নামের এক সৈনিক ক্ষমতা দখল করে সে দেশে বসবাসরত লাখ লাখ ভারতীয়কে খেদানোর ঘোষণা দিয়ে সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়েছিলেন। তখনকার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাঁকে নিয়ে কভার স্টোরি হলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছিল ‘রাবুকা’ বলে। এই আমাদের আরেক স্বভাব, এই সেদিনও বহু প-িতজন ‘ইস্তাম্বুল’ নামে বই লিখে বাজারে ছেড়েছেন। অথচ শহরটির নাম ‘ইসতানবুল’, রামবুকার ফিজিকে ভালভাবে জানার সুযোগ ঘটেছে সিডনিবাসের পর। আমাদের এই বহুজাতিক শহরে ফিজিয়ান ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত মানুষের ছড়াছড়ি। হেন কোন কর্মস্থল নেই যেখানে আপনি দু’একজন ফিজি-ভারতীয় খুঁজে পাবেন না, আদিবাসী ফিজিয়ানদেরও দেখা মেলে মাঝে মধ্যে। এই কিছুদিন আগে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত এ দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী আদিবাসী ফিজিয়ান জর্জ সেন্ট সে দেশে ক্ষমতা দখল করে ফিজির প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী মহেন্দ্র চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তাঁদের গৃহবন্দীও করে রাখা হয়েছিল, পরে তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে আসেন। জানি না এখন কোথায়, তবে জর্জ টিকতে পারেনি। নৌ কমান্ডার ক্ষমতা নেয়ার পর মূল ফিজিয়ান ও ভারতীয় ফিজিয়ানদের ভেতর সমাঝোতা হয়ে ফিজি আবারও তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণে পর্যটনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন সুভা, নাদী বা অন্যান্য শহরে বেড়াতে আসেন। প্রশান্ত মহাসাগরের এই ছোট দ্বীপরাষ্ট্রটি কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কৃত নানাভাবে সমালোচিত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছে তিরস্কৃত এবং বর্জ্য হবার পরও তার অবস্থান বদলায়নি। যে বা যাঁরা তাঁদের শান্তি ও কল্যাণে রেখেছে তাঁদের বিরুদ্ধে জ্বালাওপোড়াও কিংবা গণতন্ত্রের তথাকথিত সংগ্রামে দেশের শান্তি নষ্ট করেনি, ভারতীয়রাও আছেন বহাল তবিয়তে। যে অস্ট্রেলিয়া সে দেশে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নেই বলে চিৎকার করে সে দেশের মানুষেরও ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ ফিজি। বলাবাহুল্য তারই স্বীকৃতি দেখছি এই জরিপের ফলাফলে। নববর্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী ও অশান্তির দেশ হয়ে উঠেছে ইরাক। মানব সভ্যতার বিস্তার ও উন্মেষলগ্নের অবদানে এগিয়ে থাকা এই দেশটির এমন পরিণতি দুঃখজনক, বিশেষত যখন এ অবস্থা তার নিজের সৃষ্ট কিন্তু নয়। একসময় কথিত গণতন্ত্র বা উদারনৈতিক রাজনীতি না থাকলেও ইরাক ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ দেশ। এ লেখা যখন লিখছি তার কয়েক ঘণ্টা আগে চুল কাটিয়ে ফিরেছি এক ইরাকী ক্ষৌরকারের ছুরি-কাঁচিতে। একযুগ আগেও এই শহরে আমি কোন ইরাকী সেলুন দেখিনি। আজ কোন কোন এলাকায় সেলুন, মানে ইরাকী অথবা শ্রীলঙ্কার তামিলদের দোকান। যুদ্ধ ধ্বংস আত্মহনন আর পুঁজিবাদের প্রেসক্রিপশনে কোন কোন দেশ তলানিতে এসে ঠেকেছে। মনে মনে ভাবি বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনাও কি তাই চেয়েছিলেন? নব্য ক্লাইভ হবার খায়েশ অপূর্ণ রেখেই দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। বলা মুশকিল আসলে কোন এজেন্ডা আর কোন হিসাব ছিল তাঁর কাছে। আজকে যারা কথায় কথায় সরকারকে অগণতন্ত্রী, শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করে এক রোখা বলেন তাঁরা চোখ মেলে দেখলে বুঝবেন, আমেরিকার কথা অক্ষরে অক্ষরে না মানলেই শান্তির শীর্ষে থাকা যায়। জরিপটি বলছে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষ পশ্চিম ইউরোপের আর আশাবাদী মানুষের বাস নাইজেরিয়ায়। কী অদ্ভুত! যে ইউরোপ একদা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে তার মানুষরাই এখন সবচেয়ে অসুখী। আমার ধারণা উন্নতি ও জ্ঞানের শেষ সীমায় পা রাখার পর এখন তাদের কাছে অবতরণের বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। পুঁজি ভোগ আর পণ্য বিপণনের সমাজে মানুষ যে অসুখী হবে তাতে দ্বিমতের অবকাশ দেখি না। একটা ছোট উদাহরণ দিতে পারি, যীশুর ছবিগুলো কখনই রাজকীয় পোশাকে মোড়া নয় বরং বলতে গেলে উদোম অথবা যৎসামান্য কাপড়ে ঢাকা, সেই যীশুর জন্মদিনকে ঘিরে পোশাকবাণিজ্য দেখে মনে হয়, ধর্ম নয় বাণিজ্যই এখন বড়দিনের হাতিয়ার। এমন দেশ বা সমাজ যত সভ্য বা আধুনিক হোক, তার ভেতরটা আসলে ফাঁপা। জরিপটি তারই প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের মানুষ ও আগামী দিনের জন্য তাই পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন বা ঢালাও আদেশের বদলে নিজেদের মত ও পথের প্রয়োজন। বিদেশী বন্ধু বা প্রভুচালিত রাজনীতি আমাদের ফিজি হতে দেবে না, ভঙ্গুর উজবেক ইরাক বানিয়ে রাখবে। নববর্ষে আমরা তাই দেশজ রাজনীতি ও আদর্শের উদ্বোধন চাই। একান্ত নিজের, বাংলাদেশের সে সামর্থ্য ও সম্ভাবনা দুটোই আছে, প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। [email protected]
×