ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে ফাগুনের ধূলিঝড়-নজরকাড়া সরিষা ক্ষেত আর মৌচাক

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৪ জানুয়ারি ২০১৫

শীতে ফাগুনের ধূলিঝড়-নজরকাড়া সরিষা ক্ষেত আর মৌচাক

সমুদ্র হক প্রকৃতিপ্রেমী কবি পার্সি বি (পিবি) শেলীর কবিতার একটি পঙ্ক্তি ‘ইফ উইন্টার কাম্স ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড...’ শীত যদি এসেই যায় ফাল্গুন তো পিছনে নেই। এবারের শীতের আগমন পৌষ জানান দিচ্ছে ফাগুনের রূপ তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ডিসেম্বরে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে ঠিকই তবে হিমেল বাতাসের সঙ্গে মৃদু ফাগুনের ধুলিঝড়ও উড়েছে। যদিও আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, এবার শীতে কয়েক দফা শৈত্যপ্রবাহ বইবে। তারপর বসন্তের দিনগুলো এসে যাবে। শীতের সাক্ষী কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে ফের আত্মপ্রকাশ রোদ্দুরে। দেখে আশ মেটে না। প্রকৃতির মিলন মেলা কতই না বৈচিত্র্য। কতই না রোমান্টিকতার মধুময়তা। প্রকৃতির সঙ্গেই মানুষের বাস। শেলী লিখেছেন ‘সুইটেস্ট সংগস আর দোজ দ্যাট টেল অব এ স্যাডেস্ট থট’। পর মুহূর্তেই তিনি বসন্তকেই খুঁজে এনেছেন শীতের মধ্যে। পথ দেখিয়েছেন প্রণয়েরও। বাঙালীর ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে প্রকৃতিকে লালনের মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় নিসর্গ। শীতের কুয়াশা (যা নিচে নেমে আসা মেঘ) জানান দেয় সামনেই রোদেলা দিনের মায়া। প্রতিটি ঋতু মানব জীবনের চলার পথকে এগিয়ে দিতেই নানা প্রতিকূলতা নিয়ে আসে। এই প্রতিকূলতা যারা উত্তীর্ণ হতে পারে তারাই পায় শান্তির পরশ। প্রকৃতি নিয়ে দেশে দেশে কত কবি কত লেখক সাহিত্যিক কত কিছুই না বর্ণনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন “শীতের হওয়ায় লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে, তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে। শূন্য করে ভরে দেয়া যাহার খেলা তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা”। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁদের দেখিয়ে দেয়া পথে বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় উপন্যাসে টেনে এনেছেন প্রকৃতি। বিশ্বের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলুলয়েডের ফিতায় বিভূতি ভূষণকে তুলে এনেছেন। প্রকৃতিতে শীতের বর্ণনায় কবি শেক্সপিয়র বলেছেন ‘হে শীতের বাতাস, তুমি প্রবাহিত হতে থাক। তোমার কনকনে শীতের দংশন অত নিষ্ঠুর নয় যত নিষ্ঠুর মানুষের নির্মমতা ও অকৃতজ্ঞতা।’ বাঙালীর শীতের প্রকৃতিতে প্রথমেই আসে পিঠা-পুলি। কত বাহারি পিঠাই না বানান হয় বাঙালীর ঘরে। সংস্কৃতির এই পথেই শহরে বসে পিঠামেলা। গ্রামীণ জীবনে খেজুর গাছের মাথায় ঝুলতে থাকে কলসি। রাতভর টুপটুপ করে রস গড়িয়ে কলস ভরে ওঠে। গাছ নজরে এলেই মনে আসে শীতকাল। খেজুর গাছের সঙ্গে শীতের মমত্ব বেশি। শীতকে নিয়ে কত যে কথা....। শীত মৌসুমেই গ্রামের পথে প্রান্তরে নজর কেড়ে নেয় সরিষা ক্ষেত। হলদেটে এই ফুলের ওপর বসে মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের পালা শুরু হয়। বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত মধু সরিষার ফুল থেকেই মেলে। যা প্রকৃতির ক্ষুদ্র পাখি মৌমাছি সংগ্রহ করে দেয়। সরিষা ক্ষেতের ভিতর দিয়ে তরুণীদের পথ চলা নিসর্গ হয়ে ওঠে। শীতের সরিষাকে নিয়ে কতই না কথা। সরিষার মধ্যে ভূত কথাটি যে কে আবিষ্কার করেছে! সরিষা একটি ক্ষুদ্র দানা। এর মধ্যে ভূত (যদিও বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে ভূতের কোন অস্তিত্ব নেই। তারপরও ব্রিটেন ও আমেরিকার কিছু মানুষ এখনও ভূতের ভয় করে) ঢোকেই কি করে। একটা সময় গ্রামের (শহরেরও) মানুষ শীতের সকালে গোসলের আগে সরিষার তেল গায়ে মেখে রোদে কিছুক্ষণ বসে থাকতো। শীতের রাতে সরিষার তেল প্লেটে মেখে মশা তাড়ানো হয় এখনও। বিশ্বে শীত মৌসুমে এশিয়ায় প্রথম উৎপাদিত হয় সরিষা। যা আজও উপমহাদেশে রবিশস্য হিসেবে পরিচিত। একটা সময় হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীত এলেই মানুষের দুর্দশা ও জবুথবু হওয়ার নানা চিত্র তুলে ধরা হতো। আজ আর সেই অবস্থা নেই। গত কয়েক বছরে দারিদ্র বিমোচনের পালায় গ্রামের মানুষের ঘরে লেপ-কাঁথা কম্বল ও শীতের পোশাক আছে। জেলা শহর ও উপজেলা সদরের পথের ধারে এবং গ্রামের হাটবাজারে এখন সস্তায় শীতের পোশাক মেলে। গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এবং উন্নত জীবন গড়ায় তারাও এখন আর শীতের ত্রাণ নিতে চায় না এবং ত্রাণকে অমর্যাদাকর হিসেবেই দেখে। উল্টো শীতকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায় সেই চেষ্টা করে। এভাবেই শীত ফাগুনের আবেশে আনন্দমুখর হয়েই উঠেছে। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফেরেও পড়েছে শীতকালও। তারপরও শীতের আমেজ বলে কথা।
×