ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বালাগালউলা বেকামালিহি কাশাফাদ্দুজা বেজামালিহি/হাসানাত জামিউ খেসালিহি/সাল্লই

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৪ জানুয়ারি ২০১৫

বালাগালউলা বেকামালিহি কাশাফাদ্দুজা বেজামালিহি/হাসানাত জামিউ খেসালিহি/সাল্লই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমারই চাঁদ সেথা দোলে, যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে। মরুর রবি, সমগ্র জাহানের শ্রেষ্ঠ মানব, বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জন্ম ও ওফাত দিবস আজ। পবিত্র ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সা.)। আরব মরুর বুকে জন্ম নিলেও তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দূত। মানুষে মানুষে অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে, বাদশাহ, ফকিরকে এককাতারে শামিল করে আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রচার করে গেছেন। পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ্ যাঁকে সমগ্র মানবজাতির রহমতস্বরূপ ঘোষণা করেছেন সেই প্রিয় নবী (সা.) স্মরণে আজ উচ্চারিত হবে বালাগালউলা বিকামালিহি, কাসাফাদদুজা বিজামালিহি, হাসানাত জামিউ খেসালিহি সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী। পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের কাছে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনার দিন। তাই এদিনে বিশ্বের ১শ’৬০ কোটি মুসলমান পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রিয় নবীকে স্মরণ করবে। তাদের কণ্ঠে আরও ধ্বনিত হবে ‘ইয়া নবী সালাম আ’লায়কা, ইয়া রাসুল সালাম আলায়কা।’ পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিনটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচী নিয়েছে এবং সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র । প্রতিবছর ১২ রবিউল আউয়ালকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। পবিত্র কোরান শরীফে বর্ণিত আছে, ‘মহানবীকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীই সৃষ্টি করতেন না।’ এসব কারণে এবং তৎকালীন আরব জাহানের বাস্তবতায় ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তাই অনেক বেশি। মরুর এই দুলাল আজ থেকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আজকের এই দিনে মক্কা নগরীর পবিত্র ভূমিতে মা আমিনার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের ৬ মাস আগেই পিতা আব্দুল্লাহকে হারান। সেই সময় আরবের প্রথা অনুযায়ী তাঁর জন্মের পরপরই মক্কা থেকে দূরে বেদুঈন দুধমাতা হালিমার (রা.) ঘরে লালিত-পালিত হন। ৪ বছর পর সেখান থেকে মায়ের কোলে ফিরে আসেন। ৬ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে তিনি মদিনায় গমন করেন। দু’মাস অবস্থান শেষে মক্কায় ফেরার পথে মা আমিনাও মৃত্যুবরণ করেন। মাতাপিতাহীন শিশু মুহম্মদকে (সা.) পরম আদরের সঙ্গে বুকে টেনে নেন দাদা আব্দুল মুত্তালিব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদা মারা যাওয়ার পরই তিনি শিশু বয়সেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। অবশেষে তাঁর আশ্রয় জোটে আপন কাকা আবু তালিবের কাছে। হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয় কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রে। তাঁর জন্মের সময় হাশিম গোত্র নেতৃত্বসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপরও পবিত্র মক্কার সম্মানিত পেশাটি ছিল এ গোত্রের হাতে; যার নেতৃত্ব ছিল নবীর আপন চাচা আবু তালিব। ছেলেবেলা থেকেই তিনি কুরাইশদের কাছে সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সবাই তাঁকে বিশ্বাস করে ডাকত আল আমিন বলে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন আরব হেজাজের লোকেরা যুদ্ধ, বিগ্রহ, মারামারিতে ব্যস্ত থেকেছে। গোত্রে গোত্রে মারামারি-কাটাকাটি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। আরববিশ্ব ছিল পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। খুব ছোটকাল থেকে এসব দৃশ্য তাঁর মনে রেখাপাত করেছিল। আরবের ভয়াবহ এসব যুদ্ধের হাত থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গোত্রের সমন্বয়ে গঠন করা হয় শান্তি সংঘ বা হিলফুলফুজুল। কম বয়য়েই তিনি এ সংগঠনের অন্যতম সদস্য হিসেবে আরবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। শিশু বয়সে পিতামাতা ও আশ্রয়হীন হওয়ার পরও ৪০ বছর পর্যন্ত তাঁর জীবন অতিবাহিত হয় অনেকটা নির্বিঘেœই। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকেই আরবের কুরাইশদের হাতে অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হন ইসলাম প্রচারের অপরাধে। এ সময় তিনি মূর্তিপুজোয় নিমগ্ন কুরাইশ বংশের লোকদের পৌত্তলিকতা ছেড়ে আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর থেকে হেজাজের সব গোত্রের লোক জোটবেঁধে তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। তাঁর জীবনের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ আর হাসি, ঠাট্টা, কটূক্তি করতে থাকে তাঁর প্রবর্তিত নতুন ধর্ম নিয়ে। জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে কুরাইশ বংশের সম্মানীয় ব্যবসায়ী বিবি খাদিজার (রা.) সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৬০৫ সালে ৩৫ বছর বয়সে তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। প্রায়ই তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। কখনও কখনও সারারাত ধ্যান করেই কাটিয়ে দিতেন সেখানে। ৫ বছর ধ্যান সাধনার পর ৪০ বছর বয়সে প্রথম তাঁর কাছে ওহি নিয়ে হাজির হন ফেরেস্তা জিবরাইল (আ.)। জিবরাইলের মাধ্যমে নবুওয়াত প্রাপ্তির সুসংবাদ পান। ধ্যানমগ্নকালে ফেরেস্তার মাধ্যমে তিনি প্রথম বাণী শ্রবণ করেছিলেনঃ হে নবী পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন একফোঁটা রক্তবিন্দু থেকে। আর এভাবেই তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয় সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ কোরান মজিদ। তিন বছর পর্যন্ত তিনি কোরানের বাণী গোপনে নিজের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রচার করতে থাকেন। এরপরই তাঁকে প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচারের আদেশ দেয়া হয়। তিনি পৌত্তলিকতা ছেড়ে আল্লাহ্র একত্ববাদ মেনে নেয়ার জন্য কুরাইশদের আহ্বান জানান। এরপর থেকেই তাঁর জীবনের ওপর নেমে আসে জুলুম ও নির্যাতন। নিজ গোত্র এমনকি বৈমাত্রেয় কাকা আবু লাহাবের দ্বারাও চরম নির্যাতিত হন। কুরাইশদের চরম প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে নিজের স্ত্রী খাদিজা (রা.) এবং কাকা আবু তালিবের মৃত্যুর পর একেবারেই নিস্ব হয়ে পড়েন। অপর কাকা আবু লাহাব হাশিম গোত্রের দায়িত্ব নেয়ার পর মুহম্মদ (সা.) এর ওপর থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে কুরাইশদের প্রবল নির্যাতনের মুখে নবদীক্ষিত মুসলমানদের তিনি আবিসিনিয়ায় খ্রীস্টান গবর্নরের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে তিনি মক্কায় টিকতে না পেরে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিযরত করেন। মাত্র ২৩ বছরের মাথায় তিনি আরব হেজাজের আমূল সংস্কার আনতে সক্ষম হন। যুগ যুগ ধরে লালিত পৌত্তলিকতার মূলে কুঠারাঘাত করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি ছোটবড় অসংখ্য যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন; যার মধ্যে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ এবং খন্দকের যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন। এছাড়াও তাবুকের যুদ্ধ, খায়বরের যুদ্ধ ও তায়েফে তাঁর নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় অভিযান পরিচালিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত লোহিত সাগরের নিকট বদরের যুদ্ধে মাত্র ৩শ’ যোদ্ধা নিয়ে কুরাইশদের ১হাজার সদস্যের বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দেন। কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই মাত্র ৭শ’ সৈনিক নিয়ে তিনি মদিনার অদূরে ওহুদের ময়দানে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুসলমানরা নবী (সা.) দিকনির্দেশনা ঠিকমতো না মানায় এ যুদ্ধে তিনি প্রতিপক্ষের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এমন খবর রটিয়ে পড়ার পর কুরাইশরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু পরের বছরই আবার ১০ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণ করে কুরাইশরা। খন্দকের এই যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে মুসলমানরা কৌশল অবলম্বন করে মদিনার চারদিকে পরিখা খনন করে। ফলে কুরাইশ বাহিনী নিষ্ফলহাতে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে। এর পরে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ১ লাখ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে বিনাবাধায় মক্কা জয় করেন। এ জয়ের মাধ্যমে কুরাইশদের যুগ যুগ ধরে লালিত প্রথা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। মক্কা বিজয়ের পর তিনি সর্বশেষ মক্কায় বিদায় হজের ভাষণ দেন। তাঁর বিদায় হজের ভাষণে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, তোমাদের মাঝে আমি রেখে যাচ্ছি দুটি মূল্যবান জিনিস, ‘কোরান ও সুন্নাহ’। এ দু’টিকে তোমরা যতদিন আঁকড়ে থাকবে ততদিন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ৬৩২ সালে দীর্ঘ ৬২ বছর বয়সে আজকের এইদিনে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। হযরত মুহম্মদকে (সা.) প্রেরণ করা হয়েছিল সমগ্র মানবজাতির রহমতস্বরূপ । পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন, মুহম্মদকে সৃষ্টি না করলে আমি পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না। তাঁর আগমনে মানব জাতি লাভ করেছে কল্যাণময় পথের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা, মানবিক মূল্যবোধ ও মর্যাদার গভীরতম চেতনা। কোরানে অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে,‘আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ আল্লাহ্ আরও ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে থাকে। অতএব হে ইমানদারগণ; তোমরাও নবীর শানে দরুদ ও সালাম পেশ কর। কর্মসূচী ॥ এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে হামদ, নাত, সেমিনার ও কেরাত মাহফিল। এছাড়া বাংলাদেশ মাইজভা-ারি ফোরাম, আজিমপুর দায়রা শরীফ, তমুদ্দিন মজলিস, দেওয়ানবাগ দরবার শরীফের পক্ষ থেকে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
×