ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একুশ শতক ॥ জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০২:৪৯, ৪ জানুয়ারি ২০১৫

একুশ শতক ॥ জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা

॥ পাঁচ ॥ ইতোপূর্বে আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা এটি দেখেছি যে তাতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারটি সেভাবে প্রণীত হয়নি বলে এতে ২০০৮ সালের মতো আলোচনা নেই। আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের অনুচ্ছেদ ৯.৩-এ রয়েছে : “শিক্ষার মানোন্নয়নকে সর্বাধুনিক গুরুত্ব দেয়া হবে। এ জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হ্রাস, প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি ও শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, সকল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর ব্যবহার সম্প্রসারিত করা হবে...”। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে আমরা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের একটি অঙ্গীকারের কথা জানতে পারছি। আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাব গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি অব্যাহত রাখার কথাই এতে বলা হয়েছে। তবে ইশতেহারে যেভাবে বিষয়গুলোকে তুলে ধরা উচিত ছিল তেমনভাবে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শব্দ ও বাক্য চয়ন করা হয়নি বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। এক ধরনের দায়সারা ভাব কাজ করেছে অনুচ্ছেদটি লেখার সময়। ২০০৮ সালের ইশতেহারে যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণমূলকভাবে এই বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে তার প্রতিপলন ২০১৪ সালের ইশতেহারে তেমনভাবে নেই। ২০১৪ সালের ইশতেহারের ৯.৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে; জনসংখ্যায় শিশু-কিশোরের প্রাধান্য বিবেচনায় এ কাজটি অতিরিক্ত গুরুত্ব দাবি করে। ইতোমধ্যে কতিপয় উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে মিলে আমরা মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি সার্বিক কৌশল গ্রহণ করেছি। এ কৌশলের অংশ হিসেবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবং ব্যক্তি মালিকানা খাত ও সরকারী উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করা হবে। শিক্ষার বিষয়বস্তু বা কারিকুলামও চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবানুগ করা হবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা এবং বিভিন্ন পেশায় ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ ঢেলে সাজানোর যে কাজ শুরু হয়েছে তা সূচারুভাবে সম্পন্ন করা এবং সারাদেশে এর প্রচলন নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া, প্রত্যেক উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। বৃত্তিমলূক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় ভোকেশনাল ট্রেনিং কোর্স প্রবর্তনের কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারিত করা হবে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মডেল বিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। মূল ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কম্পিউটার ও অনার্স কোর্স চালুসহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে। এই অনুচ্ছেদেও প্রযুক্তি, বৃত্তিমূলক ও কম্পিউটার শিক্ষাকে সম্প্রসারণের অঙ্গীকার রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তার অব্যাহত যাত্রার প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে শিক্ষায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার যেসব কার্যক্রম এরই মাঝে শুরু করা হয়েছে সেগুলোর কথা কেন ইশতেহারে নেই সেটি আমার বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষার ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেগুলোর কথা এখানে বলা উচিত ছিল। তবে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধ্যায়ে এই সম্পর্কে ভিন্নভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবুও ডিজিটাল কনটেন্ট প্রসঙ্গটি আসেইনি। এতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি। অথচ শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কাজটি ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা ছাড়া হতেই পারে না। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি নামে যে অনুচ্ছেদটি সেটি ১০ নাম্বারের। এতে ১০.১ অনুচ্ছেদে রয়েছে গবেষণা ও আবিষ্কারের বিষয়াদি। একটি মেধাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রেক্ষিতে এই অনুচ্ছেদটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেধাজাত সম্পদ সৃষ্টি, তার সুরক্ষা এবং বিকাশে রাষ্ট্রের করণীয় বিষয়ে আরও স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্য অনুচ্ছেদে আছে; ১০.২ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা এবং পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন ও হালনাগাদ করা হবে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার এবং ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারিত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন দ্রুততর করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার করা হবে। সফটওয়্যার শিল্পের প্রসার, আইটি সার্ভিসের বিকাশ, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। একই সঙ্গে আউট সোর্সিং ও সফটওয়্যার রফতানি ক্ষেত্রে সকল প্রকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। ১০.৩ দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা যেমন থ্রি-জি চালু হয়েছে। ফোর-জিও চালু করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হবে। যদিও কেবল একটি বাক্য ‘একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হবে’ উল্লেখ করা হয়েছে তথাপি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, আমি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বিষয়টি আলোচনা করতে চাই। বিষয়টি এখনও কোন রাজনৈতিক তত্ত্বের আদলে আলোচিত হয়নি। আমি নিজে বিষয়টি নিয়ে সেই ২০০৩ সাল থেকেই কথা বলছি। কারও কারও মনে থাকতে পারে যে, সেই সময়ে ১০-১২ ডিসেম্বর জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সমাজ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁরা ২০০৬ সালের মাঝে বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন। তাঁরা বিশ্ববাসীর সঙ্গে একটি অঙ্গীকারনামায়ও সম্মত হয়েছিলেন। জাতিসংঘ যেখানে ২০১৫ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছিল সেখানে বেগম জিয়া ২০০৬ সালেই সেই সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু জেনেভা থেকে ফিরে তিনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এই শব্দটিই বোধহয় দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেননি। এরপর ২০০৫ সালে যখন তিউনিসে সম্মেলনটির পরের অংশ অনুষ্ঠিত হয় তখন আর বেগম জিয়া বা তার সরকারের কোন নড়াচড়া পাওয়া যায়নি। আমি এখন পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া বা তার দলের কোন লোকের কাছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কোন বিষয়ই শুনিনি। তারা হয়ত নিজেরাই জানেন না যে, এই সমাজ কাকে বলে, এর রূপরেখা কি এবং সম্ভবত এজন্য রাষ্ট্র বা জনগণকে কি করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ভাবনা, দলিল দস্তাবেজ বা অন্য কোন সূত্রে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-এর কথা নেই। আমি ধারণা করি, বিশেষজ্ঞ বা বিখ্যাত কোন ব্যক্তি প্রদত্ত না হলেও অতি সাধারণ এই সংজ্ঞাটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বোদ্ধা ব্যক্তিদেরকে এই কথাটি বোঝাতে সক্ষম যে, ডিজিটাল বিপ্লবটি শিল্পযুগোত্তর একটি কর্মসূচী। তথ্যপ্রযুক্তি এই যুগের সূচনা করেছে এবং তথ্যপ্রযুক্তিই এর মূল চালিকাশক্তি। বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০-১২ তারিখে জেনেভায় অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনে, যেখানে বিশ্ববাসীর পক্ষে ঘোষণা করা হয়, We, the representatives of the peoples of the world, assembled in Geneva from 10-12 December 2003 for the first phase of the World Summit on the Information Society, declare our common desire and commitment to build a people-centred, inclusive and development-oriented Information Society, where everyone can create, access, utili“e and share information and knowledge, enabling individuals, communities and peoples to achieve their full potential in promoting their sustainable development and improving their quality of life, premised on the purposes and principles of the Charter of the United Nations and respecting fully and upholding the Universal Declaration of Human Rights. বিশ্ববাসীর ঘোষণা থেকে কতগুলো বৈশিষ্ট্যকে যদি চিহ্নিত করা হয় তবে সেগুলো হবেÑ জনগণকেন্দ্রিকতা, সকলকেই সম্পৃক্ত করার উন্নয়নমুখী তথ্য সমাজ যেখানে প্রতিটি মানুষ সৃজনশীল থেকে সৃষ্টি করতে পারবে, তথ্য ও জ্ঞানে অবাধ প্রবেশাধিকার পাবে, এগুলো ব্যবহার করতে পারবে এবং অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবে। আওয়ামী লীগের ইশতেহার দেখে আমার শঙ্কা জেগেছে যে, দলটি সামগ্রিক বিষয় অনুধাবন করেই তাদের প্রত্যয় ঘোষণা করেছে কিনা। আওয়ামী লীগ কি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের রূপরেখা জেনে সেটি গড়ে তোলার কথা বলেছে? দলের নেতা-কর্মীসহ নীতি নির্ধারকগণ কি আদৌ জানেন যে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কাকে বলে? আমি যখন ২০০৭ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা লিখি তখন থেকেই বলে আসছি যে, মানবজাতির বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তরণ। ডিজিটাল যুগের একটি আকাক্সক্ষা হচ্ছে এটি। এজন্য সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর ডিজিটাল রূপান্তর জরুরী। আমরা যখন ডিজিটাল রূপান্তরটি সম্পন্ন করতে পারব তখন একে জ্ঞানভিত্তিক সমাজেও রূপান্তর করা সম্ভব হবে। সেই সময়ে ডিজিটাল যুগ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কি তার সংজ্ঞাও আমি উদ্ধৃত করেছি। যে বিষয়টি আমি প্রত্যাশা করব সেটি হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ শুধু একটি বাক্য বলে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটিকে যেমন উজ্জ্বল করেছে তেমনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজকে ঘিরে ৬টি শব্দ উচ্চারণ করে তার গুরুত্বটা যেন রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। আমাকে যদি বলা হয় ২০১৪ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে নতুন কি দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তবে আমি শুধু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকারের কথাটাই বলতে পারব। এখন যখন নির্বাচনটি সমাপ্ত হয়েছে, সংসদ সদস্যদের শপথ হয়েছে, সরকার গঠিত হয়েছে এবং একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তখন ইশতেহারটির বাস্তবায়নই আমাদের কাম্য। আসুন আমরা সবাই মিলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি। প্রশ্ন হতে পারে সেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজটা কেমন করে গড়ে উঠতে পারে। এর স্বরূপ, প্রকৃতি, প্রভাব ও বাস্তবায়ন কৌশল জানাটাও খুবই জরুরী। আলোচনায় আসতে পারে এর বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে। আগামীতে আমরা সেই আলোচনাই করব। ঢাকা, ২ জানুয়ারি ২০১৫ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: ww w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×