ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১২৪ কেজি সোনা আটকের মামলায় এজাহার

বিমান সম্পর্কে ঢাকা কাস্টমসের মন্তব্যে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৫

বিমান সম্পর্কে ঢাকা কাস্টমসের মন্তব্যে তোলপাড়

আজাদ সুলায়মান ॥ চাঞ্চল্যকর ১২৪ কেজি সোনা আটকের মামলার এজাহারে রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিমান সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। এ মামলার এজাহার অনুযায়ী ওই ফ্লাইটের পাইলট, কো পাইলট, চীফ পার্সার, কেবিন ক্রুসহ সব শ্রেণীর বিমান কর্মচারীরা জড়িত। অথচ এমন ঢালাও অভিযোগ যে কিছুতেই সত্য বা সম্ভব নয়, সেটাও ওঠে এসেছে শুল্ক গোয়েন্দার প্রাথমিক তদন্তে। তারপরও সে অনুসন্ধান রিপোর্ট ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দেয়ায় এখন বিপাকে পড়তে হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এ দায়-দায়িত্ব আমরা নেব না। যার নির্দেশে এমন এজাহার লেখা হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসা করুন। জানতে চাইলে অভিযুক্ত ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার হোসাইন আহমেদ কোন মন্তব্য করেননি। তোলপাড় হওয়া এ এজাহার নিয়ে বিমানের শীর্ষ পর্যায় থেকে আপাতত কৌশলগত কারণে কোন প্রতিবাদ করা না হলেও পাইলটদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চরম ক্ষোভ। তারাও এ কা-ের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আগে দেখি কি আছে এজাহারে। তারপর ব্যবস্থা। বিমান এয়ারলাইন্স পাইলট এ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব বলেন, ঢালাওভাবে যে সব অভিযোগ বা আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে, তা কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। বিমানের প্রকৌশল বিভাগ বলছে, যেখানে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর সুনির্দিষ্টভাবে ১০ জনের নামে এজাহার দায়েরের সুপারিশ করেছেন, সেখানে কিভাবে সেটা পরিবর্তন করে ওই ফ্লাইটের সবাইকে ঢালাওভাবে দায়ী করে এজাহার লিখা হলো? এতে কী রহস্য লুকায়িত রয়েছে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ মামলা দায়েরের আগে শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদন অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ ছিল। সে অনুযায়ী বিমানের ১০ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে এজাহারভুক্ত আসামি করার নির্দেশও দেয়া হয় ঢাকা কাস্টমস হাউসকে। তারপর এ হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা জামাল বাদী হয়ে গত তারিখে বিমানবন্দর থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করেন। চাঞ্চল্যকর এ মামলা দায়েরের পর দেখা যায়-এজাহারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চূড়ান্ত সুপারিশ ও সিদ্বান্ত উপেক্ষা করে একটি প্যারায় লেখা হয়, “এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বর্ণিত এয়ারক্রাফটিতে সে সময়ে কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন, কো পাইলট, ফার্স্ট অফিসারসহ সকল শ্রেণীর ককপিট এবং কেবিন ক্রু, বিমান হ্যান্ডলিং-এ কর্তব্যরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, হ্যাঙ্গারে কর্তব্যরত বর্ণিত শিফটের ইঞ্জিনিয়ার টেকনিশিয়ান ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ চোরাচালানটির স্বর্ণ পাচারে জড়িত থাকতে পারে বলে কাস্টমস মনে করে।” মামলা দায়েরের পরদিনই সেটার তদন্তভার দেয়া হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর। তারপর শুরু হয় তদন্ত। তখন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারের শেষে এমন একটি প্যারা দেখে বিস্মিত হন। ডিবির একজন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, এটা বিতকির্ত এজাহার। এমন ঢালাওভাবে কি করে বিমানের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সব শ্রেণীর লোককে সন্দেহ করা হলো? এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এদিকে কেমন করে এমন এজাহার লেখা হলো সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, মামলার এজাহারে বাদী হিসেবে যার নাম লেখা রয়েছে, তিনি রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ মোস্তফা জামাল। তিনি এটা লেখেননি। তার বিভাগীয় প্রধান হোসাইন আহমেদ এ এজাহার লিখে তাকে দিয়ে সরাসরি থানায় গিয়ে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। মোস্তফা সে নির্দেশই পালন করেন। তারপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ে এ এজাহার সম্পর্কে অবহিত করা হলে সবাই হতবাক হয়ে যান। এক পর্যায়ে এ সম্পর্কে কমিশনার হোসাইন আহমেদের কাছে এমন এজাহার লেখার কারণ ও ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। এতে কমিশনার হোসাইন আহমেদ এজাহারের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, ডিবির তদন্তের ধরন দেখে মনে হয়েছে ওই ফ্লাইটের সবাই এতে জড়িত। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন-এটা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন। হোসাইন আহমেদকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন কেন এমন করেছে। আমরা এখন এর বেশি কিছু বলতে পারব না। জানতে চাইলে হোসাইন আহমেদ কোন ধরনের মন্তব্য করেননি। উল্লেখ্য গত বছরের ২৪ জুলাই বিমানের একটি এয়ারবাসে করে আনা হয় সর্ববৃহৎ ওই সোনার চালান। ওই এয়ারবাসটি প্রথমে দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকায় আসে। তারপর সেটা নেপালের কাঠমা-ু হয়ে ফিরে আসার পর হযরত শাহ জালাল বিমানবন্দরের ১নং বোর্ডিং ব্রিজের কাছে থামে। খবর পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএনসহ অন্যান্য এজেন্সির সদস্যের উপস্থিতিতে ওই ফ্লাইটে তল্লাশি চালানো হয়। এতে উড়োজাহাজের ফ্রন্ট কার্গো হোল্ডের স্টেট বক্স থেকে উদ্ধার করা হয় কালো কাপড়ে মোড়ানো ১০৬৪টি সোনার বার। যার ওজন ছিল ১২৪ কেজি। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল থেকে কাউকে আটক করা যায়নি। এতে কাস্টমস আইনে একটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তারপর মইনুল খানের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর অন্য সদস্যরা ছিলেন, কেএম অহিদুল আলম কমিশনার মংলা কাস্টমস হাউস, কামারুজ্জামান সহকারী পরিচালক, উম্মে নাহিদ আক্তার সহকারী কমিশনার, নুরুজ্জামান ম-ল ম্যানেজার বিমান, ও ইফতেখার সিএসও শাহজালাল এয়ারপোর্ট। দীর্ঘ এক বছর তদন্তের পর গত মাসে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা এ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে। সেখানে তদন্তের বিষয়বস্তু নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায় বিমানের একটি সংঘবদ্ধ চক্র অত্যন্ত সুকৌশলে এ সোনার চালান আনে। তাদের মধ্যে বিমানের ১০ জনের নামও তথ্য প্রমাণাদিসহ উল্লেখ করা হয়। তারা হলেন, বিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার মোঃ কামরুল হাসান, সুইপিং সুপারভাইজার মোঃ আবু জাফর, এয়ারক্রাফট মেকানিক মোঃ মাসুদ, এ্যাসিস্ট্যান্ট এয়ারক্রাফট মেকানিক মোঃ আনিস উদ্দিন ভুঁইয়া, প্রকৌশল হ্যাঙ্গারের মেকানিক ওসমান গণি, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ আহমেদ, মজিবর রহমান, জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার মোঃ শাহাজাহান সিরাজ, রায়হান আলী ও মাকসুদ। এর বাইরে আরও চারজনকে আসামি করা হয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নেপাল থেকে আসার দিন ওই ফ্লাইটের যিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন, তার নাম ক্যাপ্টেন আব্দুল বাসিত মাহতাব। তার অনুমতি নিয়েই শুল্ক গোয়েন্দার টিম ওই ফ্লাইটে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে সোনার চালান। জানা যায়, শুল্ক গোয়েন্দার এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর থানায় মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তার আগে এ মামলার এজাহার লেখার সময় যাতে, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত থাকার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে পর্যন্ত অবহিত করে। এ নিয়ে বেশ পর্যবেক্ষণও করা হয়। কারণ বিমানের পাইলটদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণাদি ছাড়া ঢালাও অভিযোগে সরাসরি মামলা দায়ের করলে পরিস্থিতি কতোটা বিপজ্জনক হয় কিংবা কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এ সব বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। সবকিছু ভেবে চিন্তে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নজরে আনা হয়। তারপর এ মামলার এজাহার লেখার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু দিক নির্দেশনা ও সুপারিশসহ অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। তাতে এজাহারে কোন পাইলটকে জড়ানোর ইঙ্গিত বা নির্দেশ ছিল না। মামলা দায়েরের পর পুলিশ যাকে তদন্তে পাবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেবে। এই ছিল চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা। কিন্তু মামলা দায়েরের পর দেখা গেল এজাহারে লেখা হয়েছে আপত্তিকর মন্তব্য। এ সম্পর্কে রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার এক বছরের তদন্তে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণাদি না পাওয়ায় এজাহারের কোন পাইলটের নাম উল্লেখ না করারও সুপারিশ ছিল। কারণ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। পাইলটদের ধর্মঘটের মতো কর্মসূচী দেয়ার আশঙ্কা এড়ানোর জন্যই এত সতর্কতা অবলম্বন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু পরে মামলা দায়েরের পর এজাহারে দেখা গেল, রাজস্ব বিভাগের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে এজাহারে এমন কিছু আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে যা বিমানের সবাইকে ক্ষুব্ধ করার জন্য যথেষ্ট। মামলা নং ১৩ (১২) ২০১৪। মামলার বাদী হয়েছেন, ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা জামাল। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ফ্লাইটটি সেদিন নেপাল থেকে আসলেও মূলত স্বর্ণ আনা হয় দুবাই থেকে। তখন ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন নাদিম। আর নেপাল থেকে আসার দিন ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল বাসিত মাহতাব। জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন মাহতাব বলেন, “সেদিন ছিল আমার ছুটি। হঠাৎ বিমান থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে নেপালে যাওয়ার নির্দেশ। অসুস্থ শরীর নিয়েও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো স্বর্ণ কি নেপাল থেকে এসেছে। আর এজাহারে ওই ফ্লাইটের সকল শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত বলে যেভাবে বাদী তার মতামত উল্লেখ করেছেন সেটা কতোটা আইনসম্মত? এ ঘটনা এক বছর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে শুল্ক গোয়েন্দার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু যিনি বা যেই বিভাগ তদন্ত করেনি তাদের কাছে কেন এমন মনে হবে ওই ফ্লাইটের সকল শ্রেণীর লোক জড়িত থাকতে পারে। আসলে এসব দেখে মনে হচ্ছে আমরা সবাই মগের মুল্লুকে বসবাস করছি। এদিকে সর্বশেষ জানা যায়, এ মামলার এজাহারভুক্ত দশ জনের মধ্যে চারজনকেই বরখাস্ত করেছে বিমান। এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জানান, বাকি চারজনকেও শনাক্ত করার কাজ চলছে। তারপর তাদেরও বরখাস্ত করা হবে। ডিবি পুুলিশ জানায়, এ মামলার এজাহারভ্ক্তু দু’জনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাকি আসামি আটকেরও অভিযান চলছে।
×