ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৫ জানুয়ারি মাঠ দখলে রাখতে দু’পক্ষই অনড় ॥ বাগযুদ্ধ চরমে

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৩ জানুয়ারি ২০১৫

৫ জানুয়ারি মাঠ দখলে রাখতে দু’পক্ষই অনড় ॥ বাগযুদ্ধ চরমে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আগামী ৫ জানুয়ারি ঘিরে বাগযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দু’পক্ষই মাঠ দখলে রাখার জন্য দিচ্ছে হুমকি ধমকি। নতুন বছরের শুরুতেই এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ,উৎকণ্ঠা। ঠিক কী হবে ৫ জানুয়ারি- এ নিয়ে জনমনে কৌতূহলেরও কমতি নেই। দু’পক্ষের অনড় অবস্থান আর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও উত্তাপ ছড়িয়েছে সারাদেশে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় দু’দলই পরস্পরকে মোকাবেলায় হুমকি ধমকি দিলেও ওই দিন বড় ধরনের কোন সহিংসতার আশঙ্কা কম। কেননা, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে মোকাবেলার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা এখন বিএনপির নেই। মাঠে নেমে তাদের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব। আর আওয়ামী লীগও চাইবে না সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে বিএনপির হাতে রাজনৈতিক বড় কোন ইস্যু তুলে দিতে। দু’দলই কড়া বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার কৌশল থেকেই ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে এমন উত্তাপ ছড়ানো হচ্ছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। ৫ জানুয়ারি বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনে আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে ব্যাপক কর্মসূচী। ওই দিন দেশের তিন শ’ আসনের থানা, উপজেলা, ইউনিয়ন, জেলা, মহানগরে একযোগে বিজয় র‌্যালি, শোভাযাত্রা, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীতে রয়েছে- ঢাকা মহানগরীর ১৬টি নির্বাচনী এলাকাতেই নির্বাচিত দলীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতারা স্ব স্ব এলাকায় বিজয়ের বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও করবে জনসভা। দলটির নেতারা দাবি করেছেন, বেশ কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার অনুমতি নেয়া হয়েছে ঢাকা মেট্্েরাপলিটন পুলিশের কাছ থেকে। কর্মসূচী সফল করতে শুক্রবার সকল সহযোগী সংগঠনকে নিয়ে যৌথসভাও করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবসে সারাদেশেই বিজয় র‌্যালি, সভা-সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। ঢাকা মহানগরের ১৬ স্পটে ওইদিন বিজয় শোভাযাত্রা, সভা ও সমাবেশ হবে। গত ছয় বছর ধরেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হুমকিধমকি জনগণ দেখেছে। আওয়ামী লীগ তাতে মোটেও বিচলিত বা উদ্বিগ্ন নয়। দেশের জনগণ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাশীল। জনগণ উন্নয়ন চায়, সংঘাত চায় না। তাই ওদিন বিএনপি-জামায়াত কোন ধরনের সংঘাত বা সহিংসতার চেষ্টা করলে শক্তহাতে তা দমন করা হবে। এদিকে, বিএনপি ৫ জানুয়ারির দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যার কালো দিবস’ হিসেবে পালনে রাজধানীসহ সারাদেশে সভা-সমাবেশ করার কর্মসূচী দিয়ে মাঠে নেমেছে। বিএনপি ওই দিন ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করলেও শুক্রবার পর্যন্ত অনুমতি পায়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সম্ভাব্য সংঘাত-সহিংসতা এড়াতে বিএনপির আবেদনটি বিবেচনা করে দেখছে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, অনুমতি না পেলেও যেকোন মূল্যে ৫ জানুয়ারিতে ঢাকায় জনসভা করবে তারা। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, পুলিশের অনুমতি না পেলেও ৫ জানুয়ারিতে তাঁরা রাজপথে নামবে এবং ওদিন ঢাকায় সমাবেশ হবেই। জনসভা করতে না দিলেও দিন থেকেই আন্দোলনের নতুন অভিযাত্রা শুরু হবে। এক বছর আগে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সহিংসতা। নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াত জোট ওই সময় যে নারকীয়-পৈশাচিক উন্মত্ততায় মেতে উঠেছিল, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে রাজনীতির নামে এমন হিংসাত্মক নৃশংস ধ্বংসাত্মক রাজনীতি দেখেনি দেশবাসী। ওই সময় পুরো দেশই বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেছে। এরপর গত একটি বছর দেশে ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল গত একটি বছর বড় কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তবে ৫ জানুয়ারি ঘিরে ব্যর্থতা ও হতাশা ঝেড়ে ফেলে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলও প্রস্তুত। তারা আর কোনভাবেই দেশকে ২০১৩ সালের মতো অবস্থায় ফিরে যেতে দেবে না। আওয়ামী লীগ নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপির আন্দোলনের ঘোষণা উড়িয়ে দিলেও সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় ভেতরে ভেতরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দু’ভাবেই মোকাবেলার প্রস্তুতি চলছে ক্ষমতাসীন দলটিতে। দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি সকাল থেকেই রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থান নেবে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা। বিকেল তিনটার দিকে রাজধানীর সকল ওয়ার্ড, থানা ও ইউনিয়ন থেকে বের করা হবে বিজয় মিছিল ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। পুরো ঢাকা মহানগরীকেই তারা মিছিলের নগরী পরিণত করে রাজপথ দখলে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। ঢাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাতেই বড় বড় শোডাউনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় উৎসব পালন করবে শাসক দলটি। দু’দলের এমন পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতির মধ্যেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে ভিন্ন কথা। এসব রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রকাশ্য রাজপথে বড় আন্দোলন গড়ার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই নেই বিএনপির। সর্বশেষ ঢাকার বকশিবাজার এবং গাজীপুরের ঘটনায় দলটির সারাদেশের নেতাকর্মীরাই চরম হতাশ ও বিভ্রান্ত। তাই প্রকাশ্য রাজপথে আন্দোলনের আড়ালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি গোপনে বড় ধরনের নাশকতা বা সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে পারে। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেও তাঁদের কণ্ঠে ফুঠে উঠেছে বিভিন্ন ইস্যুতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দল দুটির দুই নেতার মতে, বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারক নেতারা মোটামুটি নিশ্চিত যে, নতুন বছরের শুরু থেকেই সরকারকে চাপে ফেলতে না পারলে নতুন বছর ২০১৫ সালের মধ্যেই সব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ঘোষিত আদালতের রায় একে একে কার্যকর করা হতে পারে। আর জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার যে শক্ত প্রমাণ ও সাক্ষী যোগাড় করেছে, তাতে কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিএনপি নেত্রী ফেঁসে যেতে পারেন। হাইকোর্ট বা আপীল বিভাগে গেলেও বিশেষ আদালতের রায়ই বহাল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে স্বাভাবিক আদালতের রায়েই খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারাতে পারেন। এমনটা হলে জামায়াত ও বিএনপি দু’দলই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে পারে। সূত্র জানায়, এমন আশঙ্কা থেকেই খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বিএনপির নেতারা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। আর এই জিডির অজুহাত দেখিয়ে আগামীতে আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলা দুটো সঠিক ধারায় চলতে না পারে সেই চেষ্টাই করবেন বিএনপির সমর্থিত আইনজীবীরা। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হাজিরার সময় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জড়ো করে পুলিশের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিও ছিল ওই পরিকল্পনারই অংশ। মামলা দুটো দ্রুত গতিতে চললে বিএনপি নেত্রী ফেঁসে যেতে পারেন, মোটামুটি তা নিশ্চিত জেনেই মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে থানায় ওই জিডি করা হয়েছে। একদিকে মামলা আর অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঠেকানোর পরিকল্পনা থেকেই বিএনপি-জামায়াত সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার যে গোপন পরিকল্পনা করছে, তা ইতোমধ্যেই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও উচ্চ মহলে জানিয়ে দিয়েছে বলেও অপর একটি সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, বিএনপি-জামায়াতের এমন তৎপরতার মুখে বসে নেই শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। সম্ভাব্য যে কোন আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে নির্বাচনী এ জোটটিতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আন্দোলনের জন্য বিএনপি-জামায়াত কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে ব্যাপারে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে শাসক দলটি। সেই অনুযায়ী দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে সতর্ক রাখার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে মাঠে নামানোর চিন্তাভাবনা চলছে দলটিতে। জানা গেছে, শুধু ৫ জানুয়ারিই নয়, ২০১৪ সালের মতো ২০১৫ সালেও যাতে বিএনপি-জামায়াত জোট রাজপথে নামতে না পারে, সে ব্যাপারেও আগাম প্রস্তুতি চলছে আওয়ামী লীগে। আন্দোলন মোকাবেলায় প্রশাসনিক প্রস্তুতির পাশাপাশি জামায়াত-বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত পুরনো মামলাগুলো সচল, দল দু’টির সন্ত্রাসী-ক্যাডার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শাসক দলের নেতারা মনে করেন, জিয়া অরফানেজ মামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা দুটো প্রমাণযোগ্য। আর মামলা দুটির রায়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা হলে সারাদেশেই বিএনপির নেতাকর্মীরা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। আর এটি সম্ভব হলে সারাদেশে বর্তমানে উজ্জীবিত ও সংগঠিত আওয়ামী লীগের সামনে আগামী এক বছর কেন, মেয়াদের পুরোটা সময়ই বিএনপি দাঁড়াতেই পারবে না।
×