ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মঙ্গার পাশাপাশি শীতের দুর্যোগও জয় করেছে ওরা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২ জানুয়ারি ২০১৫

মঙ্গার পাশাপাশি শীতের দুর্যোগও জয় করেছে ওরা

শাহীন রহমান ॥ মঙ্গা জয়ের পাশাপাশি শীত নিবারণে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠছে দেশের দরিদ্র জনসাধারণ। একখানা কম্বল বা শীতের গরম কাপড়ের জন্য অন্যের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে না। নিজেরাই নিজেদের শীতের গরম কাপড়সহ প্রয়োজনীয় চাহিদার যোগান দিতে সক্ষম। অথচ এক বছর আগেও শীত এলেই উত্তরের জনপদের মানুষের কছে যেন এক অজানা আতঙ্ক নেমে আসত। শীতবস্ত্র নেই। শীত নিবারণে কোন ব্যবস্থা নেই। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় আর কনকনে ঠা-ায় জীবন যেন থেমে যেতে চায়। প্রতিবছর শীতের এই সময়ে কয়েক শ’ লোকের মৃত্যু যেন স্বাভাবিক বিষয়। এছাড়া ঠা-াজনিত রোগব্যাধি তো আছেই। কিন্তু এবারের শীতে তার ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের ওপর দিয়ে হিমেল হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডা বয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শীতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যুও খুব কমই। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা আগের যে কোন বছরের চেয়ে অনেক কম। অথচ বিগত কয়েক বছরের শীত মৌসুমের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে প্রতিবছর শীতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কয়েক শ’ ছাড়িয়ে গেছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। শুধু মাত্র ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৭২ জনের মৃত্যুও খবর রয়েছে। ওই বছরে পুরো শীত মৌমুমে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২শ’ কাছাকাছি। এছাড়া ২০১৩ সালেও শীতজনিত রোগের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড় শ’। বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশু শীতে আক্রান্ত হয়েছে। এবারের শীতে ব্যতিক্রমী চিত্র পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পৌষের ১৮ তারিখ পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুব কমই। শীতে মৃত্যুও সংখ্যা যেন হাতেগোনা। তবে শীতের দুর্ভোগ যে নেই তা নয়। শীত কষ্টের মতো পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দিতে সক্ষম হচ্ছে তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে দারিদ্র্য পীড়িত উত্তরের জনগণসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। উত্তরের জনগণ মঙ্গা মোকাবেলার পাশাপাশি এখন শীতও ভালভাবেই মোকাবেলা করতে সক্ষম হচ্ছে। কাজের অভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে না। দুবেলা অন্য বস্ত্র যোগান দেয়ার পাশাপাশি শীতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও তারা এখন সক্ষম। এক হিসেবে দেখা গেছে দেশের প্রতি তিনজনের দুজনই কর্মক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির কারণে এখন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি শীতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়েছে আগের চেয়ে। এছাড়াও শীত মোকাবেলায় সরকারের রয়েছে যথেষ্ট প্রস্তুতি। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণের কারণে গবির মানুষদের এখন আর আগের মতো শীতে কষ্ট করতে হচ্ছে না। বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও যথেষ্ট শীতবস্ত্র বিতরণের কারণেও সহজেই শীতের ভোগান্তি অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মঙ্গা মোকাবেলায় পাশপাশি উত্তরের মানুষসহ দেশে দরিদ্র জনগণ শীত ম্যানেজমেন্টও ভালভাবেই সামাল দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরিব দুস্থরা এখন আর অপুষ্টির শিকার হচ্ছে খুব কমই। কাজের অভাবে তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে না। শস্যের বহুমুখীকরণ সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় ভূমিকার কারণে মঙ্গা কেটে উত্তরাঞ্চলের মানুষের সব সময় কর্মব্যস্ত রাখে। আর্থিক সচ্ছলতা বেড়ে যাওয়ায় শীতের মতো প্রাকৃতির দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন অন্যের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। আবাহওয়বিদদের মতে, শীতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হিমেল হাওয়া হিমালয় পার হয়ে উত্তরের জনপদ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে উত্তরের জনপদের মানুষের শীতে একটু বেশিই ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কিন্তু এবারের ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ করা গেছে। নিজের শীত নিরাবণে তারা এখন যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছুদিন আগে উত্তর জনপদের মানুষের ধান কাটার উৎসব শেষ হয়েছে। নবান্ন শেষেই শীতের আগমন। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ধরনও যেন বদলে যায়। এখন শীত মূলত তাদের জন্য শুধু প্রকৃতিক দুর্যোগ নিয়েই আসছে না। আশীর্বাদ হিসেবেও দেখা দিচ্ছে। শীতের ফলে লাউ, কপি, মুলা, গাজর, সীম, বরবটিসহ শীতের সবজির সমারোহ সারাদেশে। কৃষকের এসব নিয়েই এখন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। জনকণ্ঠের কুড়িগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার রাজু মোস্তাফিজের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এবারের শীতে এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রামের মৃত্যুও সংবাদ পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর এই সময়ে শীত মৌসুমে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ থেকে ১৫ জনের মৃত্যু হলেও এবারের চিত্রি ভিন্ন। এছাড়া শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে প্রায় ২শ’ রোগীর চিকিৎসা নেয়ার ঘটনা ঘটালে এবারের তা দেখা যায়নি। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও প্রতিবছর দরিদ্র মানুষের কাছে শীতবস্ত্র নিয়ে হাজির হয়। বিভিন্ন কারণে এবারের শীতে দরিদ্র মানুষের কষ্ট বা ভোগান্তি আগের চেয়ে অনেক কম। নীলফামারীর থেকে স্টাফ রিপোর্টার তাহমিন হক ববি জানান, প্রতিবার শীত মৌসুমে কমপক্ষে ৭শ’ থেকে ৮শ’ দরিদ্র জনসাধারণ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এবারের শীতে আক্রান্ত হয়ে কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যায়নি। এছাড়া শীতে ১০ থেকে ১৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এবারের সে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি এখনও। উল্টর জনপদের তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-ধরলা নদীবিধৌত রংপুর বিভাগের নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মানুষজন মঙ্গা জয়ের পাশাপাশি এবার কনকনে শীতকে রিতিমতো মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন যাত্রাও যেন বদলে যায়। শীতের ফলে লাউ, কপি, মুলা, গাজর, সীম, বরবটিসহ শীতের সবজির সমারোহের করণ শীত এখন আশীর্বাদ হয়েও দেখা দিয়েছে। সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ শিল্পকলকারখানা বেকারত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি কৃষি সেক্টরে আগাম ফসলের ঢেউ। ফলে ঘরে ঘরে নেই খাদ্য ঘাটতি। এখন এই খেটে খাওয়া মানুষজন শীতে মোকাবেলায় গরম কাপড়সহ রাতে ঘুমানোর সময় রিতিমতো লেপ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ফজলুল হক তানসেন বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় শীত জনিত রোগ কমেছে। তার মতে মানুষজনের আয় বেড়েছে। মানুষের শরীরের পুষ্টিগত চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সহজে তাদের শীতজনিত রোগ আক্রমণ করতে পারছে না। এতে শীত জনিত রোগে মৃত্যুর হার কমে এসেছে। রাজশাহীর স্টাফ রিপোর্টার মামুনুর রশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেকে বেড়ে গেছে। ফলে নিজেরাই নিজেদের চাহিদা মোকাবেলায় সক্ষম। অন্যের মুখের দিয়ে কাউকে চেয়ে থাকতে হয় না। ফলে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা গতবারের চেয়ে অনেক কম। মৃত্যুও সংখ্যাও অনেক কমে এসেছে।
×