ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী বানিয়ে মানুষ মেরে ক্ষমতায় আসতে চান লজ্জা করে না ॥ এরশাদ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২ জানুয়ারি ২০১৫

জঙ্গী বানিয়ে মানুষ মেরে ক্ষমতায় আসতে চান লজ্জা করে না ॥ এরশাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আগামী নির্বাচনের রূপরেখা তৈরি করতে সব দলকে এক হয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি বলেন, ঐক্য ছাড়া জাতির মুক্তি নেই। এভাবে দেশ চলতে পারে না। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশকে চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও জঙ্গীবাদের জন্ম দিয়ে মানুষ হত্যা করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চান, লজ্জা করে না। আপনি ইতিহাসের ফল ভোগ করছেন। আমি ক্ষমতায় যেতে টিকে আছি, থাকব। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে ১৮ দফা প্রস্তাবও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত। সমাবেশে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সকল ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সঙ্গে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা না করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। ১০ লাখ মানুষের জমায়েত টার্গেট করে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেদিক বিবেচনা করলে তেমন লোক সমাগম হয়নি। তবে গেল পাঁচ বছরের মধ্যে এটিই ছিল জাপার সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক কর্মসূচী। এরশাদ বলেন, আমাদের যাত্রা আজ থেকে শুরু হলো। আমরা সরকারের ভাল কাজে সমর্থন দেব। সরকারের জনবিরোধী কাজের বিরোধিতা করে সংসদ ও রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলব। তিনি বলেন, আজকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি কোন বাধাই মানি না। আমাদের লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। তিনি বলেন, আমাদের একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। এক দল আরেক দলের শত্রু। আমরা শত্রুতা ভুলে গিয়ে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন হানাহানি-ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অস্ত্রবাজি বন্ধ করি। কিভাবে আগামীদিনে নির্বাচন হবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই। এছাড়া জাতির মুক্তি নেই। শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি এখন রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে এমন মন্তব্য করে সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ বলেন, এভাবে দেশ চলতে পারে না। আজকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালে জাতীয় পার্টির দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু হলো। আমরা আর ভয় পাই না। আমরা সবাই বীর। জাতীয় পার্টি চায় সুশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। আমাদের লক্ষ্য আগামীতে ১৫১ আসন। তিনি বলেন, ঢাকায় সাতটি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছিল। ফলে, রাষ্ট্রকে এ জন্য জরিমানা দিতে হয়েছিল। কারণ, যারা কাজ শুরু করেছিল, হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয়ায় হাইকোর্টে রিট করে। ফলে, রাষ্ট্রকে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। ওই ফ্লাইওভার হলে আজ ঢাকায় কোন যানজট হতো না। তিনি বলেন, বিএনপি ঢাকাবাসীর সঙ্গে অবিচার করেছে। বিএনপির সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, আমাকে অন্যায়ভাবে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তখন মাসে একবার স্ত্রী, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারতাম। কিন্তু এখন খালেদা জিয়ার দুই ছেলে দুই জায়গায়। কতদিন দেখা হয়নি, তার কোন হিসাব নেই। কবে দেখা হবে, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। তিনি বিএনপির উদ্দেশে বলেন, দেশ ক্রিকেট, ফুটবল বা অন্য কোন খেলায় চাম্পিয়ন হয়। কিন্তু, বিএনপি সরকার বাংলাদেশকে পর পর চারবার দুর্নীতিতে চাম্পিয়ন করেছে। লজ্জা করে না আপনাদের! আপনারা আবার কোন্ মুখে ক্ষমতায় আসতে চান! কোন মুখে আপনারা রাজনীতি করেন! দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বানিয়ে আমাদের পৃথিবীর কাছে হেয় করেছেন। জঙ্গী সৃষ্টি করেছেন। বাংলাভাই বানিয়েছেন। সারাদেশে বোমা হামলা করেছেন। বিচারক হত্যা, কৃষক হত্যা, কানসাটে হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আবারও ক্ষমতায় যেতে চান? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করায় তারেক রহমানের সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, এক যুবরাজ ল-নে বসে বলেন, বঙ্গবন্ধু নাকি রাজাকার। এটা কোন সুষ্ঠু রাজনীতি হতে পারে না। খালেদা জিয়া দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু করেছিল একথা উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, আপনাদের সময়ে আমাকে সমাবেশ করতে দেননি। এখন নিজেরাই সমাবেশ করতে পারেন না। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, মনে রাখবেন ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। কোনদিন করেনি, করবেও না। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পক্ষ নিয়ে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে নির্বাচন হতো না। আমি বলেছিলাম, ঘরে থাকলে খুন, বাইরে গেলে গুম হতে হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস চলছে। ছাত্রদের হাতে কেন অস্ত্র আসবে? নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার কি বিচার হয়েছে কেউ জানি না। ছাত্রদের হাতে কলম তুলে দেন। অস্ত্র তুলে দিলে জাতি কোনদিন এগিয়ে যেতে পারবে না। জামায়াতের সমালোচনা করে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, আমরা দুইমাস আগে মহাসমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করেছি। এরপরও তারা হরতাল ডেকেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহমর্মিতা নেই। এই চিন্তাচেতনাকে আমি ঘৃণা করি। তিনি সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব দলের প্রতি আবেদন, আসুন একসাথে বসি। সমাবেশ করি। আলোচনা করে শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরিয়ে আনি। আমি সবচেয়ে সিনিয়র রাজনীতিবিদ। তাই আপনারা সব দল আসুন। দেশে শান্তি ফেরাতে ও সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে রূপরেখা তৈরি করি। সরকারের সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, ছয় বছরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৭২ জন খুন হয়েছে। অন্যান্য দলে ৭৪ জন। কিন্তু আমার সময়ে নূর হোসেনকে পরিকল্পিত হত্যা করা হয়েছিল। এখন দিনে কত হত্যাকা- হচ্ছে এর হিসেব নেই। দেশের বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ। আমার প্রতি অবিচার করে, অন্যায়ভাবে জেলে পুরে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বিএনপি প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে সেভাবে শাস্তি পেতে হচ্ছে। হলমার্কস, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ বিদেশে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ বলেন, পাচার হওয়া অর্থের খবর নেই। ঘটনার বিচারও নেই। এখন শুনছি সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। আমি বলি দাম না বাড়িয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এনে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি দিন। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করলে রাজপথে আন্দোলন ও সংসদ থেকে ওয়াকআউট করব। গরিব মানুষকে কষ্ট দেবেন না। তিনি বলেন, ৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে আমার দল সমর্থন দিয়েছিল। ক্ষমতায় এসে সরকার আমাকে জেলে দিল। সুবিচার কোথাও পায়নি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আমার সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সংখ্যালঘুদের ওপর ও তাদের মন্দিরে হামলা হয়। এখনও তা চলছে। তিনি বলেন, আমি আছি, থাকব। জাতিকে অরাজক অবস্থা থেকে মুক্ত করব। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাসহ আমি ক্ষমতায় যেতে চাই। গেলে সুশাসন ও উন্নয়ন হবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থাকবে না। ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের ৪৩ বছরের প্রত্যাশা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এরশাদের ১৮ দফা ॥ দফাসমূহের মধ্যে আছে- প্রাদেশিক সরকার প্রবর্তন, নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা প্রদান, উপজেলায় আদালত পুনর্প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা চালু, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা দলীয়করণমুক্ত রাখা, ধর্মীয় মূল্যবোধকে সবার উর্ধে স্থান দেয়া, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব দমনে কঠোর আইন করা, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা যাবে না, কৃষকদের ভর্তুকিমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও কৃষকদের বিরুদ্ধে কোন সার্টিফিকেট মামলা না রাখা, কৃষিজমি বা ফসলি জমি নষ্ট করে কোন স্থাপনা কিংবা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা আইন করে বন্ধ করা, খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইন করা, শিক্ষার্থীদের টিউশননির্ভরতা ও কোচিং বন্ধ করা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, হরতাল-অবরোধসহ জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এমন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী নিষিদ্ধ করা, হত্যা-খুন-গুম-ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অবিলম্বে সকল রাস্তাঘাট সংস্কার করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ৫০ ভাগ প্রশস্ত করা, দ্রুত সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন, সারাদেশে পর্যায়ক্রমে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রত্যেক উপজেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা। ঐক্যের আহ্বান রওশনের ॥ সমাবেশে যোগ দিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, দলের বিভক্তির কারণে অনেক কর্মী বুঝতে পারেন না, কোথায় যাবেন। ফলে লাখ লাখ কর্মী বিভক্ত হয়েছেন। আমরা আর বিভক্তি চাই না। এক পার্টি দেখতে চাই। আমি উদাত্ত আহ্বান জানাব, আসুন আমরা মিলেমিশে কাজ করি। যারা দল ছেড়ে চলে গেছেন তাদের আবারও ফিরে আসার আহ্বান জানান তিনি। জাতীয় পার্টির সভাপতিম-লীর সদস্য রওশন আরও বলেন, মানুষের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, তা শুধরে আমাদের কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্ম ও নারীকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। দলছুট নেতাদের দলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যতবার নির্বাচন হয়েছে এর পরপরই দল ভেঙ্গেছে। রওশন এরশাদ বলেন, রাজনৈতিক দলের ঐক্য ও লক্ষ্য থাকে। জাতীয় পার্টি অনেক ভাল কাজ করেছে। তারপরও ২৪ বছর ক্ষমতার বাইরে। তাই আমাদের কী সমস্যা, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি দল ক্ষমতায় যেতে চায়। ’৯১-এ জাতীয় নির্বাচনের সময় আমরা জেলে ছিলাম। ’৯৬-এ আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান জেলে ছিলেন। ২০১৪ সালে চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমি নির্বাচন করেছিলাম। যুবসমাজকে রক্ষায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ দেন তিনি। রাজনৈতিক সমস্যা দূর করে মিলেমিশে দেশ গড়ার প্রস্তাব দেন রওশন। বিরোধী দলের নেতা বলেন, গেল নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে ভাল হতো। তারা হয়ত সরকার গঠন করত। অংশ না নিয়ে ভুল করেছে বিএনপি। এখন আগামী নির্বাচনের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনের নামে দেশে কোন অরাজকতা করা ঠিক হবে না। মানুষ অরাজকতা পছন্দ করে না। আমরা কাকে মারব। তিনি বলেন, আমরা শোষণ, দুর্নীতিমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক দেশ চাই। চাই সোনার বাংলা। মঞ্চে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মশিউর রহমান রাঙ্গা, মুজিবুল হক চুন্নু, রুহুল আমিন হাওলাদার, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এমএ হান্নান, কাজী ফিরোজ রশীদ, সালমা ইসলাম, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, সুনীল শুভরায়।
×