ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন বছরে গণক টিয়া শোনাচ্ছে আশার বাণী

ভাগ্য ফিরবে প্রাপ্তিযোগ চমকপ্রদ উচ্চারণ স্বপ্নের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ জানুয়ারি ২০১৫

ভাগ্য ফিরবে প্রাপ্তিযোগ চমকপ্রদ উচ্চারণ স্বপ্নের কথা

মোরসালিন মিজান ॥ বেকারের জীবন। কাঁড়ি কাঁড়ি ইন্টারভিউ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাছের নাম, মাছের নাম বলা। এর পরও সোনার হরিণ সুন্দরবনে থাকে। চাকরি হয়ে ধরা দেয় না। আর চাকরি নেই তো প্রেমিকার বাবা ভিলেন। কিছুতেই বেকারের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। এ অবস্থায় করণীয় কী? কেউ তা বলে দেন না। গত বছর চাকরির সন্ধান করে ক্লান্ত যুবক আব্দুল হালিম তাই টিয়াপাখির সামনে এসে বসেছিলেন। নাম বলতেই তৎপর হয়ে গেল গণক টিয়া। মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা বেশ কিছু চিঠির খাম। সেখান থেকে একটি ঠোঁট দিয়ে তুলে আনল। বুঝিয়ে দিল তার মালিককে। সেখান থেকে অব্দুল হালিমের হাতে। তিনি পড়লেন। তার পরও প্রশ্ন। উত্তর দিচ্ছিলেন বিশু। গণনা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছেন হালিম। সুসংবাদ ধরা দেই দেই করে দেয়নি। নতুন বছর ২০১৫ সালের প্রথম ভাগটিও অত ভাল যাবে না। ‘ফারা’ আছে। তবে মাঝামাঝিতে, মানে মে জুনের দিকে শনি কেটে যাবে। তখন তুঙ্গে উঠবে বৃহস্পতি। চাকরিযোগ আছে। প্রেমিকাকে না পেলেও ভাল ঘরে বিয়ে হবে তাঁর। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন জ্যোতিষী বিশু। শাহবাগ শিশুপার্কের সামনে বসেছিলেন তিনি। গুলিস্তানের জ্যোতিষী সাইফুলের অবস্থা আরও ভাল। তার সামনে নাতিদীর্ঘ লাইন। হাত দেখছিলেন। রেখা পড়ে দিব্যি বলে দিচ্ছিলেনÑ কী হবার আর হবার নয় যা যা! হ্যাঁ, আধুনিক যুগ। বিজ্ঞানের বিশ্ব। তাতে কী? মন অত কিছু বুঝতে চায় না। বিপদগ্রস্ত মানুষ, অসুখী মানুষ সব চেষ্টা করে দেখতে চান। কী ফল শেষতক হবে বলা মুশকিল। তবে টিয়ার সামনে এসে বসা মানুষগুলোর চোখে সুখী হওয়ার স্বপ্ন। জীবনে সফল হওয়ার আকাক্সক্ষা। দেখে সত্যি ভাল লাগে। নতুন বছরে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে ব্যস্ত এলাকা, পার্ক বা উদ্যানের পাশে পসরা সাজিয়ে বসেছেন জ্যোতিষীরা। সারা বছরই বসেন। তবে এখন নতুন বছর। ফলে ব্যস্ততা বেড়েছে। মেঝেতে মাদুর পেতে বসেছেন তাঁরা। চলছে হাতের রেখা পড়ার কাজ। কারও আছে গণক টিয়াপাখি। কেউ কেউ আবার মুখ দেখেই ভেতরের কথা বলে দিতে পারেন। শুনেই মনে হবে, সত্যি তো! হ্যাঁ, বিষয়টির উপর দুই একটি বই তাঁরা পড়েছেন। তার চেয়ে বেশি বিদ্যে বুদ্ধি! ওই দিয়েই চলছে ২০১৫ সালের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। শাহবাগে বিশুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা। পরিচয় জেনে নিজের ঠিক পাশের জায়গাটি ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করলেন। বললেন, ‘আপনে গুনি মানুষ। কিছু মনে না করলে বসেন।’ প্রথমে মনে হয়েছে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা। আসলে এ ছিল সারল্য। ফলে বসতেই হলো। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তাঁর কাছে হাত দেখানোর ফিস ১০ টাকা। টিয়ার গণনা ১০ টাকা। নানা বয়সী লোকজন এসে হাঁটু গেড়ে বসছিলেন। চলছিল ভাগ্য গণনা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাম শুনে প্রায় প্রত্যেকের বেলায় বলা হচ্ছিলÑ ‘আপনার লাকি নাম। ভাইগ্য ভাল।’ এরপর বাকি কথা। কিন্তু এমন শুরুর ব্যাখ্যা কী? জানতে চাইলে সরল স্বীকারোক্তি বিশুর। বলেন, কত মানুষ কত দুঃখ কষ্ট নিয়া আসে। উনাদের মন খারাপ কইরা দিতে চাই না। আশার কথা শুনলে তো ধরেন বাঁচব বেশি দিন।’ এমন কথা শুনে মানুষটির চোখের দিকে কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বিশু স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘ভাইগ্য পাইতে কাজ করতে হয়। আমার কাছে তো ভাইগ্য নাই। খালি আশাটা দেই। না দিলে চলে না।’ একইভাবে জ্যোতিষী স্বীকার করে বলেন, টিয়াগুলো বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। এরা বোবা। ধরেন যে, শিশুর মতো। শিশুদের দিয়া লটারির টিকেট তোলে না মানুষ, সেই রকম কাজ করাই। তিনি জানান, খামের ভেতরে লিখে রাখা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো খাবনামা থেকে নেয়া। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও, তাঁর মতে, খাবনামার সত্তর থেকে আশি ভাগ সত্যিই হয়! তবে বেশি সত্য হাতের রেখা। তিনি বলেন, ‘অনেক দিনের চর্চা। আমি হাত দেইখা মুখ দেইখা অনুমান করতে পারি কিছু। তবে পরের কথাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, মানুষের কত দুঃখ কষ্ট। আমি তারে একটা কথা বইলা সান্ত¡না দেই। এইটা তো খারাপ না। গুলিস্তানে আবার একাধিক জ্যোতিষী। একেকজন একেক কোণে বসে ভাগ্যগণনা করেন। সাইফুল ইসলাম বেশ সেজেগুজে বসেছিলেন। গায়ে রং জলা ব্লেজার। গলায় মাফলার প্যাঁচানো। প্রথমে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। কেন? অনেক চেষ্টার পর বোঝা গেল, তিনি অভিমান করে আছেন। তাঁর অভিযোগÑ সাংবাদিকরা এসে কথা বলে। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা লিখে দেয়। এতে ব্যবসার ক্ষতি। সঙ্গত কারণেই তাঁকে আশ্বস্ত করতে হয়। এরপর পাশে বসার অনুমতি মেলে। কিছুক্ষণ বসে দেখা যায়, এখানেও নতুন বছরের হিসাব নিকাশ। কেন যাবে? বিভিন্ন বয়সী মানুষ এসে হাত দেখাচ্ছিলেন। একজন ছাত্র। নাম সাব্বির। তার হাত দেখে সাইফুল ভবিষ্যদ্বাণী করলেনÑ বিদেশ যোগ আছে। কথাটা শুনে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো ছাত্রটিকে। পটাপট টাকা দিয়ে চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন। এবার মধ্য বয়সী। তাঁকে মুখস্থের মতো ভাল-মন্দ বলা হলো। কিন্তু তাতে যেন হচ্ছে না। এই প্রশ্ন। ওই প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন ভবিষ্যত দ্রষ্টা! তাঁর কথার মাঝ প্রচুর ইংরেজী শব্দ। জানালেন, মেট্রিকটা ফেল করেছিলেন। তারপর থেকে এই কাজে আছেন। নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘এই কাজ এক ধরনের বিনোদন। যারা আমাদের কাছে আসে তারা খুশি হইয়া যায়। আমরাও তাদের দুঃখের কথা শুনি। মন হাল্কা হয়। তবে ভাই ঠগাই না কাউরে।’ তিনি যোগ করেন, ‘ভবিষ্যত সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কইলে এক জায়গায় বইসা ব্যবসা করা যাইব?’ তবে অন্যের ভাগ্য গণনা করলেও নিজেরা সত্যি দুর্ভাগা। তিন বেলা খেতে পান না অনেকেই। এভাবে ৩০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন মনসুর আলী নামের আরেকজন। বললেন, ‘আমার ভাগ্য আমার হাতে নাই। থাকলে তো বাড়ি গাড়ি হইত। তবে চর্চা করলে, কিছু বই পুস্তক পড়লে ভাগ্য সম্পর্কে আপনারও ধারণা হইব। সেই ধারণা থাইকা মানুষরে আশার কথাটা কই। তাতে উপকার না হোক, ক্ষতি হয় না।
×