ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নতির পাশাপাশি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪

উন্নতির পাশাপাশি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রতিবছর এ ঘটনা কম-বেশি ঘটে থাকে। তবে ২০১৪ সালে এ সব ঘটনার পাশাপাশি ছিল ব্যাংকিং খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন। গেল বছর মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন, স্কুল ব্যাংকিং ও কৃষকের ব্যাংক হিসাব, রেকর্ড পরিমাণে রেমিটেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ইতিবাচক সংবাদ। একই সঙ্গে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এমডি ও চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক ও পারিবারিক আধিপত্য, দুর্নীতি নিরসনে পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ, ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুট, সুড়ঙ্গ কেটে ডাকাতির চেষ্টা, ব্যাংকের শাখা থেকে গ্রাহকের চেক ও গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া উচ্চ সুদের হার, ব্যাংকে অলস টাকা ও খেলাপী ঋণ নিয়ে বছরব্যাপী আলোচনায় ছিল ব্যাংকিং খাত। ২০১৪ সালকে ব্যাংকিং খাতের উন্নতি ও ঘটনাবহুল বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলেছেন, ব্যাংকিং সেক্টরে ২০১৪ সালে ঋণ কেলেঙ্কারি ও ঋণ খেলাপীর দায়ভার অনেক বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে ব্যাংকিং মুনফা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত এক বছরে বেশকিছু কাজ হয়েছে; তবে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগের জন্য আরও জোর দেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এটা আর্থিক খাতের ভিত মজবুত করলেও এ অর্থ বিনিয়োগে আনা দরকার। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুট ও নথি গায়েব ॥ কিশোরগঞ্জসহ দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুটের ঘটনায় সারাবছরই আলোচনায় ছিল গোটা ব্যাংকিং খাত। যদিও ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি গোপন সুড়ঙ্গপথে কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় কিছু টাকা উদ্ধার হয়। এরপর ৯ মার্চ একই ব্যাংকের বগুড়ার আদমদীঘি শাখায় একই কায়দায় ৩২ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ২৭ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের ব্র্যাক ব্যাংক থেকে দেয়াল কেটে ভল্ট থেকে ২ কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ৪ ডিসেম্বর রাজশাহী নগরীতে সোনালী ব্যাংকের কোর্ট বাজার শাখায় সুড়ঙ্গ কেটে ডাকাতির চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর গাজীপুরের জয়দেবপুরে জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা থেকে ৬০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। একই দিন জনতা ব্যাংকের শ্যামপুর শাখার সিঁড়িতে এক ব্যবসায়ীর ব্যাগভর্তি ১৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তা ভেদ করে টাকা লুটের ঘটনার পাশাপাশি গেল বছরে ব্যাংকের শাখা থেকে গ্রাহকের চেক ও গুরুত্বপূর্ণ নথিও গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ২৭ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকের লালমাটিয়া শাখার ক্লিয়ারিং সেকশনের ড্রয়ার থেকে থেকে অর্ধশতাধিক চেক চুরি হয়। পরে অবশ্য থানায় জিডি এবং তদন্ত কমিটি গঠন হলেও সেগুলো আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে কমপক্ষে ১৪টি ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের চেক, ডিডি, এফডিআর ডকুমেন্ট, এসডিআর, এমটিডিআর, পে-অর্ডার, আমদানি-রফতানির এলসি ডকুমেন্টের মতো গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকশ’ নথি চুরি হয়ে যায়। পর্ষদের পারিবারিক বিস্তার ও ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ ॥ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও হাতাহাতির ঘটনা নতুন নয়। তবে এবার যোগ হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য। যেমনÑ ছেলে ও মেয়েকে পরিচালক করার জন্য পর্ষদকে অনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। নিজেদের নামের পরিবর্তে স্ত্রী, পুত্র, ভাই বা কোন আত্মীয়স্বজনকে ঋণগ্রহীতা দেখিয়ে এর বৈধতা এবং পর্ষদের অনৈতিক কাজে সমর্থন না দিলেই পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে ব্যাংকের এমডিদের। গত বছরের এসব ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল গোটা ব্যাংকিং খাত। এসব ঘটনার প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ॥ রাষ্ট্রায়াত্ব বেসিক ব্যাংকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে ঋণ বিতরণে অনিয়মের এ ঘটনায় ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান এবং শান্তিনগর শাখার ঋণ বিতরণ কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২৬ মে অপসারণ করা হয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। অনিয়মের দায় মাথায় নিয়ে গত ৬ জুলাই পদত্যাগ করেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। ব্যাংকে অলস টাকা ও ঋণ-আমানতের সুদহার ॥ ব্যাংকে টাকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অলস টাকা থাকলেই সমস্যা বলছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে ৪৪ হাজার ৬৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোতে ৫১ হাজার ৩৭৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, বিদেশী ব্যাংকগুলোতে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি ৮৪ লাখ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু বেসিক ব্যাংকে ৪২০ কোটি টাকার তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। এদিকে গত এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকঋণের সুদহার কমেছে ১ শতাংশেরও বেশি। এখন গড় সুদহার ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এক বছর আগে ছিল ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সুদের হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে এখন আসেনি। সুদের হার বেশি থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৪ সালে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। একইভাবে আমানতের সুদহার এখন ৭ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। খেলাপী ঋণ ॥ ব্যাংকব্যবস্থাপনার কালো অধ্যায় বলতে খেলাপি ঋণকে বোঝানো হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এ খেলাপী ঋণ। গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ এখন ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপী ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। রিজার্ভ ও রেমিটেন্স ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ বৃদ্ধি ছিল গত বছরের সবচেয়ে ইতিবাচক সংবাদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ (রিজার্ভ) ফের দুই হাজার ২০০ কোটি (২২ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে তিন বার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়ালো। প্রতি মাসে ৩ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এ রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ছাড়ায় চলতি বছরের ৭ অগাস্ট। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রফতানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গত বছরের তুলনায় বেড়েছে রেমিটেন্স। চলতি বছরের ১১ মাসে (নবেম্বর পর্যন্ত) দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলার। এছাড়া মাসওয়ারি হিসেবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। অর্থনীতির অগ্রগতির ফলে বর্তমানে দেশে আট কোটি ৫০ লাখ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট রয়েছে।
×