ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ জয় বাংরা॥ বাংলাদেশের জয় ধ্বনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

অভিমত ॥ জয় বাংরা॥ বাংলাদেশের জয় ধ্বনি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক- এমনটি যাঁরা চাননি তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন তাঁরা কোন না কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ঘাপটি মেরে থাকা এসব ব্যক্তি আজ অনুকূল পরিবেশ বুঝে তাঁদের আসল চেহারা প্রদর্শন করছেন। যেমন বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমানও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পরবর্তীতে ক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে পাকিস্তানের সেই জিন্দাবাদ ধ্বনি চালু করেছিলেন। পুনর্বাসিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের এবং রাজাকার আবদুল আলীম ও শাহ আজিজ গংকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন। এ কে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১ : ভিতরে বাইরে’ বইয়ের মন্তব্য নিয়ে জাতীয় সংসদে তুমুল আলোচনা হয়েছে। নিন্দাও জানানো হয়েছে। বইটি এখনও অনেকের পড়া হয়নি। সুতরাং বইতে কি লেখা আছে আমজনতার তা জানা নেই। আলোচনায় যে কথাটা উঠে এসেছে সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষ শব্দ ছিল নাকি ‘জয় পাকিস্তান’। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ ‘জয় বাংলা’ বলে শেষ করেননি, তিনি ‘জয় পাকিস্তান’ও বলেছিলেন! বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ বহুল প্রচারিত হতে শুনি সেটাতে নাকি ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ বাদ দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নায়করাই যদি ইতিহাস বিকৃত করেন তার চেয়ে চরম দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে? জয় বাংলা নিয়ে যাঁদের চুলকানি আছে তাঁরা হয়ত মুক্তিযুদ্ধকালের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ অর্থাৎ উপ-অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে নিশ্চয়ই উল্লসিত হবেন। তাঁরা এইবার কোচের ছুরি দিয়ে কোচ কাটায় আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। ইতোমধ্যেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মিথ্যাচারের বাদ্য-বাজনা বাজাতে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ কে খন্দকারের মন্তব্য প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যাচার করছে।’ ভাগ্যিস লেখা হয়নি যে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ না বলে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেছিলেন! তাহলে হয়ত বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলাটাও সিদ্ধ হতো। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আবাহনটি মূর্ত হয়ে উঠেছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়েই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও ‘জয় বাংলা’ এই ধ্বনিটি হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র এবং স্বাধীনতার মূর্তপ্রতীক। জিন্দাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক সেøাগান। সকল ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদের আঁতুড়ঘর। ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদ, সকল হিংস্রতা, কূপম-ূকতা সেখান থেকে জন্ম নিয়েই বর্ধিত হয়েছে। জয় বাংলা বলতে ধর্ম অবমাননা হয়! যাঁদের মনে স্থান করে আছে পেয়ারে পাকিস্তান তাঁরাই বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলতে বেশি পছন্দ করেন। সুতরাং জিন্দাবাদ বলা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাঁদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে! বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের এমন এক প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় সেই রকমেরই একটা আওয়াজ দেয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। যাঁরা ধর্মের কথা বলেন, জিন্দাবাদের সাফাই গান তাঁদের ধার্মিকতা নিয়েই অনেকের অনেক প্রশ্ন আছে। হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর যাঁরা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে শহীদ হয়ে যেতে চান উভয়ই আদর্শিকভাবে এক সূত্রে গাথা। জিন্দাবাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ভয়ঙ্কর অপশব্দ। এই শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কোন্ কোন্ দল জিন্দাবাদ বলে তারা হোক ডান অথবা বামপন্থী তাদের অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকের ধর্ম পালনে কোন যথার্থ কারণ ছাড়া বাধা না দেয় তাহলে সেই রাষ্ট্রের আমিরের তথা রাষ্ট্রপ্রধানের অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বা প্রেসিডেন্টের আনুগত্য করা ইমানের অংশ। জয় বাংলা যে রাষ্ট্রের ভিত্তি তাকে অস্বীকার করে সেই রাষ্ট্রে কারও রাজনৈতিক অধিকারই থাকাও সমীচীন নয় বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সমার্থকÑসম্পূরকও। জয় বাংলাকে এত ভয়ের কি কারণ? ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতবরণ করার পরে বাংলাদেশ থেকে জয় বাংলা প্রায় নির্বাসিত হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে যেভাবে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারিত হতো এখন সেইভাবে রাষ্ট্রের সকল স্তরে জয় বাংলা বলা হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলেও সরকারী আমলা এবং নিরপেক্ষ সুশীল সমাজ এখনও জয় বাংলা বলতে লজ্জাবোধ-কুণ্ঠাবোধ করেন। অনেকেই বলেন, জয় বাংলা দেশের সেøাগান নয়, এটা আওয়ামী লীগের দলীয় সেøাগান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও জয় বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি একটি কবিতায় জয় বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা, বাঙালীর জয় হোক।’ সেই জয় বাংলা নিয়েই আজ যত আপত্তি-বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস-অপচেষ্টা চলছে। জয় বাংলা যে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ধ্বনি নয়, এটা যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জয় ধ্বনি তা ২০১৩ সালে প্রমাণিত হয়েছে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন তাঁরা কেন এটা বোঝেন না যে, জয় বাংলা ও জিন্দাবাদ শব্দ দুটি আদর্শগতভাবে সাংঘর্ষিক সেøাগান। কী চমৎকার যুক্তি জিন্দাবাদ উর্দু বলে যদি বর্জন করা যায় তাহলে আওয়ামী উর্দু শব্দ হওয়ায় তা কেন বর্জন করা হবে না? তা না হলে বাংলা ভাষাকেই নতুন করে লেখতে হবে! এই ধরনের মন্তব্যে বাচ্চারা তালি বাজাবে নাকি চড়াবে সেটা একবার ভেবে দেখা দরকার। কবি নির্মলেন্দু গুণ মন্তব্য করেছেন, ‘এই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি বিদ্রƒপবৎ এবং নিশ্চিতভাবেই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ আজকের দিনে তরুণ প্রজন্মের সকলের কাছেই বাঙালী জাতি হিসেবে জয় বাংলা ধ্বনিটাই সবচেয়ে আন্তরিক এবং প্রাণবন্ত মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে যাবার সময় জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে যেতেন। ফিরে এসে বলতেন জয় বাংলা। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একদিনে নয়, মুক্তিযুদ্ধ ছিল হাজার বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই একটি রাজনৈতিক বিষয়। এই রাজনৈতিক নেতৃত্বের পুরোধা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলার বিপরীতে পাকিস্তানী স্টাইলে যারা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চালু করেছে এবং এখনও সেটিকে আঁকড়ে ধরে আছে তাদের আলাদা রাজনীতি ছিল এবং এখনও আছে। এক সময় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি সেøাগান খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ‘জয় বাংলা’ এবং সিন্ধু প্রদেশে ‘জিয়ে সিন্্ধ।’ সিন্ধুনেতা ছিলেন বেজেঞ্জো, তাঁকে ঘিরেই সেøাগানটি ব্যবহৃত হতো। ‘জয় পাকিস্তান’ নামক শব্দটি কখনও উচ্চারিত হয়নি পূর্ব পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধু সেই সময় কখনও জয় পাকিস্তান উচ্চারণ তো দূরের কথা এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানকে কখনই মনেপ্রাণে স্বীকার করেননি। জয় বাংলাকে ধারণ করে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। লেখক : সাংবাদিক
×