ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

জন্মশতবর্ষে হৃদয়স্নাত ভালবাসায় শিল্পাচার্য জয়নুল স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

জন্মশতবর্ষে হৃদয়স্নাত ভালবাসায় শিল্পাচার্য জয়নুল স্মরণ

মনোয়ার হোসেন ॥ মানবমমতায় তাড়িত হয়ে ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন। প্রকৃতি ও জীবনকে ভাসিয়েছিলেন আপন মননতাড়িত রেখার শরীরে। একদিকে এঁকেছেন স্বদেশ ও সমষ্টির জীবনচিত্র অন্যদিকে গড়েছেন শিল্পের শিক্ষালয়। এভাবেই দেশের চিত্রশিল্পের জনক থেকে হয়েছেন চারুশিল্প চর্চার ভিত্তিভূমি রচনাকারী। সেই কিংবদন্তি শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শততম জন্মবর্ষ ছিল সোমবার। পৌষের হিমেল সকাল থেকেই পথিকৃৎ শিল্পীকে জানানো হয়েছে শ্রদ্ধাঞ্জলি। দিনভর নানা আয়োজনে এসেছেন স্মরণে। জাতির নান্দনিক ও সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করা এই চিত্রশিল্পীকে নিবেদন করা হয়েছে হৃদয়ের উষ্ণ ভালবাসা। জন্মশতবর্ষে নিজেকে জন্মভূমির প্রতি নিবেদিত করার প্রতিদানস্বরূপ ভেসেছেন অসীম বন্দনায়। তাই তো জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে নানা আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতায় দিনটি যেন ছিল জয়নুলময়। এবার জয়নুলের জন্মদিনটি হাজির হয়েছে অনেক বেশি আবেদন আর রংময়তায়। জন্মের শুভক্ষণের শততম বর্ষ পাড়ি দেয়ার আনন্দ ধরা পড়েছে পরতে পরতে। জাতীয় পর্যায়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্্যাপন যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। শিল্পাচার্যকে নিবেদন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেয়া হয়েছে বর্ষব্যাপী বহুমাত্রিক কর্মসূচী। এ আয়োজনের সূচনা পর্বটি শিল্পানুরাগীদের জন্য দারুণ প্রাপ্তিময় হয়ে হাজির হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে পুরনোদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে জয়নুল সৃজিত শিল্পকর্ম অবলোকনের অবারিত সুযোগ। জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শালয়ে শিল্পাচার্যের আঁকা ১০০ ছবি নিয়ে শুরু হলো প্রদর্শনী। অন্যদিকে এই শিল্প দিশারীর গড়া চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চারুকলা অনুষদ আয়োজিত জয়নুল মেলায় দিনভর চলেছে নানা আনুষ্ঠানিকতা কিংবা আয়োজন। সকাল থেকে রাত অবধি বর্তমান চারুশিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাবেকদের জমজমাট আড্ডার সঙ্গে ছিল সঙ্গীত পরিবেশনা, সেমিনারসহ মনমাতানো নানা আয়োজন। শিল্পপিপাসুদের অনেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে। এখানে চলছে জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নকশিকাঁথার প্রদর্শনী। সন্ধ্যায় ছিল জয়নুলের শিল্পকর্ম উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বিশেষ আয়োজন। আজ মঙ্গলবার থেকে ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় শুরু হবে পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানমালা। আর আগামী ১১ জানুয়ারি থেকে অনুষ্ঠিতব্য সোনারগাঁওয়ের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের মাসব্যাপী মেলাটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিল্পাচার্যকে। শিল্পাচার্যের সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ সোমবার দিনের প্রথম প্রভাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জয়নুলের সমাধিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয় ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সংস্কৃতি সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ইকরাম আহমেদ চৌধুরী এবং জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের পরিচালক ওদুদুল বারী চৌধুরীর নেতৃত্বে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শিল্পাচার্যের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পাশাপাশি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, কপিরাইট অফিস, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও জয়নুল আবেদিনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় । জন্মশতবর্ষে জয়নুলের ১০০ ছবির প্রদর্শনী ॥ জাতীয় পর্যায়ে শিল্পাচার্যের শততম জন্মবার্ষিকী উদ্্যাপনে নেয়া হয়েছে বছরব্যাপী কর্মসূচী। এ আয়োজনের অংশ হিসেবে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে শুরু হলো জয়নুল আবেদিনের আঁকা ১০০ ছবির প্রদর্শনী। জাদুঘরে সংগৃহীত জয়নুলের ৮০৭টি চিত্রকর্ম থেকে বাছাইকৃত ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রদর্শনী। পরবর্তী এই শিল্পকর্মগুলো নিয়ে প্রকাশ করা পাঁচ খ-ের এ্যালবাম। প্রদর্শনীটি জয়নুলের জল রং, তেল রং, কালি ও কলম, ড্রইংসহ নানা মাধ্যমের বহুমাত্রিক বিষয়ের চিত্রকর্ম অবলোকনের সুযোগ করে দিয়েছে শিল্পানুরাগীদের জন্য। ঠাঁই পেয়েছে জল রংয়ে চিত্রিত ৭০ ফুট দীর্ঘ নবান্ন শিরোনামের বিখ্যাত ছবিটি। আছে কালি-তুলি ও মোমে আঁকা ২৮ ফুট দীর্ঘ তাৎপর্যপূর্ণ শিল্পকর্ম মনপুরা-৭০। অনবদ্য রেখা ও সাবলীল রঙের মাধুর্যে আঁকা অন্য কয়েকটি হৃদয়গ্রাহী চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছেÑ নৌকা চালানো, মা ও শিশু, রমণী ও কলস, বাজারের পথে, মুক্তির সংগ্রাম, অনুশীলন (তিন বেদেনী), রিকশাচালক, রমণী, দুর্ভিক্ষের স্কেচ, মুক্তিযোদ্ধা, মৃত হনুমান, স্টিমার ও নদী, পটের যুদ্ধ (প্যালেস্টাইন), মওলানা ভাসানী, মুক্তির সংগ্রাম, পাঠানের মুখ, মা ও শিশু, নৌকা চালানো, কুটির, ব্যঙ্গচিত্র, জেলে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, ব্রিটিশ শাসক, হরিণ, শস্য বহন, জেলে, সাঁওতাল, দুইটি হরিণ ইত্যাদি। আরও রয়েছে শিল্পাচার্যের দেখা লন্ডন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, মিসর, প্যালেস্টাইনসহ নানা শহর ও দেশের ওপর আঁকা ড্রয়িং ও জল রংয়ের ছবি। ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এ প্রদর্শনী। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করেছে জাতীয় জাদুঘর। চারুকলার জয়নুল মেলার সম্মাননা ॥ শিল্পাচার্যের গড়া প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত চার দিনের জয়নুল মেলার শেষ দিন ছিল সোমবার। লোকজ আঙ্গিকে সজ্জিত মেলার সমাপনী দিনে প্রদান করা হয় জয়নুল সম্মাননা। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা পেয়েছেন ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী অধ্যাপক গোলাম মোহাম্মদ শেখ ও বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী। সকালে অনুষদের বকুলতলায় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁদের এই সম্মাননা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পাচার্যের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য দুই শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও রফিকুন নবী। সমাপনী সকালে উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। এরপর ছিল সম্মাননা প্রদান ও আলোচনা পর্ব। অনুষ্ঠানে চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনী ও শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। এদিনের বৈকালিক আয়োজনে সঙ্গীত পরিবেশন করে চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। ছিল স্মৃতিচারণ ও জমাটবাঁধা আড্ডা পর্ব। সন্ধ্যায় বসে গানের আসর। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নাশিদ কামাল, কৃষ্ণকলিসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা। এছাড়া গান শোনান চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থীদের গড়া ব্যান্ড মেঘদল, বাউলা, তনুশ্রী ও মাস্টারব্যান্ড। শিল্পাচার্যের সংগৃহীত নকশিকাঁথার প্রদর্শনী ॥ গত মঙ্গলবার থেকে ধানম-ির বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নকশিকাঁথার প্রদর্শনী। নজরকাড়া ও নান্দনিক ২২টি নকশিকাঁথা দিয়েছে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনী। চলবে আগামী বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। ময়মনসিংহে পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানমালা ॥ জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে আজ মঙ্গলবার থেকে ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় শুরু হবে পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানমালা। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আলোচনাসভা, চিত্র প্রদর্শনী, লোকমেলা ও সংগীতানুষ্ঠান দিয়ে সাজানো হয়েছে এই মেলা। আজ বেলা ৩টায় প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন চার বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান ও রফিকুন নবী। উদীচীর স্মরণে জয়নুল আবেদিন ॥ প্রামাণ্যচিত্রের মোড়ক উন্মোচন, আলোচনাসভা ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিল্পাচার্যের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করলো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তোপখানা রোডের উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত জয়নুল স্মরণ অনুষ্ঠানের শুরুতেই সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর শুরু হয় আলোচনাসভা। উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে আলোচনায় শিল্পাচার্যের জীবনের নানা দিক ও তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন উদীচীর সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার, সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন ও সম্পাদকম-লীর সদস্য ইকবালুল হক খান ইকবাল। উদীচীর সম্পাদকম-লীর সদস্য প্রদীপ ঘোষের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্ম নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ম্যাডোনা-৪৩’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন সংগঠনে সভাপতি কামাল লোহানী। উদীচীর কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগের প্রযোজনায় নির্মিত ‘ম্যাডোনা-৪৩’ প্রামাণ্যচিত্রটি গ্রন্থনা ও পরিচালনা করেছেন প্রদীপ ঘোষ। প্রামাণ্যচিত্রটির মূল বিষয়বস্তু হলো ১৯৪৩ সালের ভয়াল দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুল আবেদিনের আঁকা কিছু চিত্রকর্ম ও তার ইতিহাস। ৩০ মিনিট ব্যাপ্তির প্রামাণ্যচিত্রটিতে জয়নুলের জীবনী নয়, তাঁর চিত্রকর্মকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ প্রামাণ্যচিত্রে চিত্রকলায় বিশেষ পর্যায়ের চিত্রশৈলী ‘ম্যাডোনা’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
×