স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পাঁচটি অগ্রাধিকারভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্র হচ্ছে- বাণিজ্য, কৃষি, শিল্পোন্নয়ন, জ্বালানি ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। এছাড়া তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। এছাড়া সরকারের সঙ্গে আলোচনায় দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে কোন কথা বলেননি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তিন দিন ঢাকা সফরের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এসব কথা জানান। এদিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন ঐতিহাসিক বিবাদ ও সংঘাত ছিল না। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ করবে না বলেও তিনি জানান।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন দিনের বৈঠক শেষে সোমবার ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তিন দিনের সফর শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক।
এএইচ মাহমুদ আলী জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয় আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টা। এছাড়া বিনিয়োগ, কৃষি, যোগাযোগ, পর্যটন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিদ্যুত, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা যোগাযোগ সম্প্রসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে ‘গুরুত্বর্পূণ প্রতিবেশী’ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি গত জুনে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের কথা স্মরণ করে ওই সফরকে অত্যন্ত সফল বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। মাহমুদ আলী বলেন, আগামী বছর চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পূর্ণ হবে। এটি বাংলাদেশ ও চীন উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণজ্যি ঘাটতি হ্রাস করার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে অধিক পণ্য আমদানির, বিশেষত পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের ক্ষেত্রে চীনা মন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আপাতত বাংলাদেশে অধিকতর চীনা বিনিয়োগের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়াও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি অগ্রাধিকারভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। এসব ক্ষেত্র হচ্ছেÑ বাণিজ্য, কৃষি, শিল্পোন্নয়ন, জ্বালানি ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। শিল্প ও বাণিজ্যসংক্রান্ত একটি যৌথ কার্যদল এবং একটি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ ফোরাম গঠনে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাগত জানান।
মাহমুদ আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল স্থাপনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিষয়ে দুই পক্ষের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা সম্প্রসারণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, উভয় দেশ বিসিআইএম দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিসিআইএমের যৌথ সমীক্ষার দ্বিতীয় বৈঠক সফলভাবে আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। বিসিআইএম স্থাপনে চতুর্দেশীয় সমঝোতা স্মারক দ্রুত বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নেয়ার বিষয়ে দুই দেশ আবারও ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সদ্যসমাপ্ত ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাতটি অগ্রাধিকারমূলক ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়াও সাংহাই কর্পোরেশন সংস্থা (এসসিও) ও এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (এপেক) বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে চীন সরকার সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে।
চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বিবাদ ছিল না ॥ চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন ঐতিহাসিক বিবাদ ও সংঘাত ছিল না বলে জানিয়েছেন সফররত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বাংলাদেশের সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল না’ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষাপট স্পষ্ট না হলেও তিনি বাংলাদেশকে নতুনভাবে দেখার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, কৃষি উৎপাদন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও যন্ত্রকৌশল খাতে ‘উন্নত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা’ বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময় করতে প্রস্তুত চীন।
রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক ॥ পাঁচ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চীন কোন হস্তক্ষেপ করেনি। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশসহ কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সোমবার ঢাকা ছাড়ার আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠক শেষে বিরোধী দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিককে জানান, বৈঠকে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টরে চীনকে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান রওশন এরশাদ। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি ম্যাডামকে বলেছেন- আপনার অবস্থান ভাল। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আপনি দেশের প্রকৃত উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।’
বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদও গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী রওশন দলের একাংশের নেতাদের নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন এবং ভোটে জিতে হন বিরোধীদলীয় নেতা।
ভারতে চাল রফতানি করা হবে ॥ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে ভারতে চাল রফতানি করতে যাচ্ছে সরকার। এতদিন বাংলাদেশই ভারত থেকে চাল এনে নিজেদের চাহিদা পূরণ করত, তবে এবার চালের উৎপাদন বেশি থাকায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে চাল যাবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী এ কথা জানান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আইর বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে যে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে চাল গেছে। আমাদের প্রচুর চাল উৎপাদন হওয়ায় এবার ভারতেও চাল রফতানি করা হচ্ছে। ভারতে শুধু চাল রফতানিই নয়, আলু রফতানির বিষয়েও আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা বাস্তবায়ন বাকি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: