ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুন্দরবন দীর্ঘমেয়াদী মহাসঙ্কটে পড়েছে তেলের প্রভাবে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবন দীর্ঘমেয়াদী মহাসঙ্কটে পড়েছে তেলের প্রভাবে

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস তেলবাহী কার্গো ডুবির ঘটনায় সুন্দরবন দীর্ঘমেয়াদী মহাসঙ্কটে পড়েছে। ভারি তেলের কারণে সুন্দরবনের ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার নদী ও বনের প্রাণী প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর পানির ভেতর মাছের ডিম, রেণু পোনা, জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় সুন্দরবনের মহাবিপর্যয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এনভায়রন-মেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ১২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে তেলের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। ওই সময়ের মধ্যে মোট ৮ দিন প্রতি ৪৮ ঘণ্টা পর পর ১৫টি স্থান থেকে গবেষণার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে তেল নিঃসরণ হয়নি এমন এলাকা পশ্চিম সুন্দরবনের ঘড়িলাল, জোড় সিং ও কলাগাছিয়া এলাকা থেকেও তথ্য উপাত্ত নেয়া হয়। তেল নিঃসরণ হওয়া শ্যালা নদী ও পূর্ব সুন্দরবন এবং পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্যে তুলনা করে গবেষণার ফল বের করা হয়। গবেষক দলের প্রধান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে তেল নিঃসরণের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদী। পানির ভেতরের পরিবর্তন এবং এর ফলে বনের পশু-পাখি ও গাছপালার ওপর এর প্রভাব পড়বে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে। ফলে এসবের ওপর নির্ভরশীল কুমির, ডলফিন, শূকর, হরিণসহ সুন্দরবনের গোটা জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এমনকি কুমির ও ডলফিন এ অঞ্চল থেকে সরে যেতে পারে। তিনি বলেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে শ্যালা নদীর নৌরুটটি বাতিল করতে হবে। এর পাশাপাশি সুন্দরবনের কোন স্থান দিয়েই তেলবাহী ও কয়লাবাহী কোন জাহাজ চলতে দেয়া যাবে না। কয়লা তেলের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। যদি কয়লাবাহী জাহাজ এখানে ডুবে যায়, তার ক্ষতি হবে আরও ভয়ঙ্কর। সে ক্ষতি কোনভাবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না। খুবি’র অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে ফার্নেস তেলের কারণে পানিতে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ফাইটো প্ল্যাংটন হলো জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক। স্বাভাবিক পরিবেশে পানিতে ৪৫টি প্রজাতির ফাইটো প্ল্যাংটন সুন্দরবনের নদীতে পাওয়া গেছে। কিন্তু তেল নিঃসরণের পর আক্রান্ত অঞ্চলে তা কমে মাত্র ১৬টি প্রজাতিতে এসেছে। এর ফলে পানির ভেতর প্রাথমিক খাদ্যস্তর ভেঙে পড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, তেল আক্রান্ত অঞ্চলের মাটিতে আগে যেখানে প্রতি কেজিতে তেলের উপস্থিতি ছিল দুই থেকে চার মিলি গ্রাম, এখন তা ৩৭০ থেকে এক হাজার ৬৯০ মিলিগ্রাম হয়েছে। তেল নিঃসরণের আগে সুন্দরবন অঞ্চলে ব্যাঙের রেণু- এ রকম ছোট ৩৪টি বেনথস প্রজাতি পাওয়া গেলেও গবেষণাকালে মাত্র আটটি প্রজাতি সেখানে পাওয়া গেছে। বাকি ২৬টি নেই। তেল নিঃসরণের আগে পূর্ব সুন্দরবনে এবং সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলে- জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী স্থানে লবণ পানির ওয়াটার লিলি নামক জলজ উদ্ভিদটি প্রতি বর্গমিটারে ১০ থেকে ১৪টি দেখা যেত। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর উদ্ভিদটি গোড়া পচে সবই মরে গেছে। খুবি’র গবেষণায় দেখা গেছে, তেল আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ফল নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি বর্গমিটারে সুন্দরী গাছের ফল ৯ থেকে ১৪টি পাওয়া গেলেও এর ৯৫ শতাংশের ভ্রƒণই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি বর্গমিটারে ৯৫ ভাগ শাসমূলীয় উদ্ভিদের গায়ে তেলের কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। ফলে সুন্দরী ও শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেল আক্রান্ত অঞ্চলে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে। এ ছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। বাদামি শৈবাল সাধারণত ছোট ছোট খালের পাশে জন্মায়। শ্যালা নদীতে তেল নিঃসরণের আগে প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ ডিসেম্বরের শুরু থেকে প্রতি লিটার পানিতে খরশোলা, পারসে, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির ডিম ও রেণু পাওয়া যেত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার। কিন্তু গবেষণার সময় দেখা গেছে, তেলের কারণে এ অঞ্চলের পানিতে কোন ডিম ও রেণু পোনা নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় মাডস্কিপার প্রতি বর্গমিটারে পাওয়া তিন থেকে সাতটি দেখা গেলেও তেল ছড়ানোর পর একটিও দেখা যায়নি। মাডস্কিপার মূলত পাখি, ভোঁদড় ও সাপের খাদ্য। গবেষণাকালে সুন্দরবনে বিরল মাস্ক ফিনপুটের দেখা মেলেনি। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে হাঁস জাতীয় পাখি মাস্ক ফিনপুট কদাচিৎ দেখা যায়। সুন্দরবনে এ পাখি রয়েছে ২০০-এর মতো। তেল নিঃসরণের আগে ২০টি মাস্ক ফিনপুট পাখি দেখা গেছে এ অঞ্চলে। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষণা অঞ্চলের কোথাও এ পাখিটি গবেষকরা দেখতে পাননি। মাছরাঙা, বকসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে এ অঞ্চলে দেখা যেত। গবেষণাকালে কোন মাছরাঙা দেখা যায়নি, তবে ১৭টি বক তেল মাখা অবস্থায় দেখেছেন গবেষকরা। গবেষণাকালে গবেষণা এলাকায় কোন জীবিত কাঁকড়া ও জীবিত শামুক দেখা যায়নি। অসংখ্য মরা কাঁকড়া ও শামুক দেখা গেছে। কাঁকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য। শামুক মাছ, পাখি ও কুমিরের খাদ্য। গবেষণার সময় তেল মাখা অবস্থায় মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিন থেকে ছয়টি কুমির দেখা যায়। সুন্দরবনের তেল আক্রান্ত অঞ্চলে দুটি মৃত ভোঁদড় দেখা গেছে। এ ছাড়া তেল গায়ে মাত্র একটি ভোঁদড় জীবিত দেখা গেছে। কোন ডলফিন গবেষকরা দেখেননি। তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোন হরিণের দেখা মেলেনি। গবেষণা এলাকায় দুই প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে ছয়টি মরা ও দুটি তেল আচ্ছাদিত অবস্থায় দেখা যায়। চারটি জলসাপ বা ডোরাসাপ মরা পাওয়া গেছে। আর দুটি এ ধরনের সাপের গায়ে তেলের প্রলেপ দেখা গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১ থেকে ২৭টি গুইসাপ দেখা গেলেও তেল আক্রান্ত অঞ্চলে তেলের প্রলেপযুক্ত দুটি গুইসাপ দেখা গেছে। আর একটি গুইসাপ পাওয়া গেছে মৃত। তেলে আক্রান্ত অঞ্চলে কোন বনমোরগ ও শূকরের দেখা মেলেনি।
×