ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জয় নিপীড়িত মানবের জয়...চাই সাম্যের সমাজ

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

জয় নিপীড়িত মানবের জয়...চাই সাম্যের সমাজ

মোরসালিন মিজান ॥ লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয়/ শোষিত মানুষের একতার জয়।/ রাখব না রাখব না শোষণের চিহ্ন/ রাখব না রাখব না কলুষতা দৈন্য।/ থাকবে না দারিদ্র্য দীনতার ভয়/ জয় নিপীড়িত মানবের জয়...। নিপীড়িত, নির্যাতিতদের পক্ষে, শোষিত-বঞ্চিতদের পক্ষে আরও একবার অবস্থান স্পষ্ট করল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সঙ্গীত নৃত্যনাটকের ভাষায় সারা দেশের কর্মীরা সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানালেন। বহুদিন পর একত্রিত হওয়ায় হাসিরাশি আনন্দ ছিল সর্বত্র। উদীচীর ঊনবিংশ জাতীয় সম্মেলনের সেøাগান ছিলÑ নিত্য বাজুক বজ্রবীণা, মানুষ জাগুক জয়ে। এই সেøাগান ধারণ করে চলেছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। এদিন উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল প্রধান ভেন্যু সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল শত শত কর্মী। তাঁদের নানা বিষয়ে আলোচনা। গল্প। সমাজ। রাষ্ট্রের খুঁটিনাটি নিয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে চলেছে কুশল বিনিময়। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছেন। এভাবে জমজমাট মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল গোটা এলাকা। পরে শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় উদ্বোধনী আলোচনার। উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। এতে অংশ নেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাহিত্যিক জাকির তালুকদার, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার। বক্তারা সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। শোষণ-নিপীড়নমুক্ত সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণে উদীচীর যে কর্মপ্রয়াস, তার সাফল্য কামনা করে বক্তারা বলেন, স্বাধিকার আদায়ের লড়াই, মুক্তির সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে উদীচী। কখনও নেতৃত্ব দিয়েছে। কখনও অনুঘটকের ভূমিকায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের স্বার্থেই উদীচীর টিকে থাকা এবং এর উত্তরোত্তর আয়তন বৃদ্ধি করা জরুরী। অনুষ্ঠানে এদিন বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় শ্রমিক আন্দোলনের নেতা জসিম উদ্দিন ম-লকে। উদীচীর পক্ষ থেকে জসিম উদ্দিন ম-লের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়। গলায় পরিয়ে দেয়া হয় উত্তরীয়। সম্মাননা গ্রহণ করে তিনি বলেন, বর্তমান সমাজব্যবস্থা ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে না বরং তা জিইয়ে রাখতে চায়। এ সমাজ ভাঙার ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সঙ্গীত নৃত্যনাটকের ভাষায় এ লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে উদীচী। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে তাদের কাছে সাম্যবাদ, মুক্তির বার্তা শোনানোর জন্য তিনি উদীচীর শিল্পী-কর্মীর প্রতি আহ্বান জানান। আলোচনা শেষে মধ্যাহ্ন বিরতি। সকলেই তখন মিলনায়তনের বাইরে। একসঙ্গে দৃশ্যমান হন শত শত কর্মী। জাতীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ কানায় কানায় ভরে ওঠে। এ সময় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছিলেন। খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। চলছিল কুশল বিনিময় পর্ব। মধ্যাহ্ন বিরতির পর শুরু হয় সম্মেলনের সাংগঠনিক পর্ব কাউন্সিল অধিবেশন। উদীচীর তিন শতাধিক শাখা থেকে আগত প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকরা এতে অংশ নেন। সূত্র জানায়, অধিবেশনে উদীচীর বিগত দিনের কর্মকা-ের মূল্যায়ন, ভবিষ্যতের পথচলা ও কর্মকৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সন্ধ্যায় ফের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে অংশ নেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আসা উদীচীর কর্মীরা। সকলেই বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন। নানা আঙ্গিকের পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন উদীচীর বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং ঢাকা বিভাগের শিল্পীরা। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের শিল্পীরা অনুষ্ঠানে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অনিক বসুর পরিচালনায় ছিল ‘স্পন্দন’র দলীয় নৃত্য। এখানেই শেষ নয়, ছিল খ্যাতিমান শিল্পীদের আবৃত্তি। এদিন একক আবৃত্তি করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন বাচিক শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও বেলায়েত হোসেন। এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। এদিন বয়স ভুলে সকলেই উৎসবে মেতেছিলেন। দলবেঁধে নেচেছেন। খালি গলায় গেয়েছেন। এরই মাঝে চলে রঙের খেলা। কিছুক্ষণ পর পর রং ছুড়ে মারা হয়। কখনও এর গায়ে। কখনও ওর। অনেকে ইচ্ছা করেই গায়ে রঙ মাখেন। এভাবে দারুণ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। শুরু হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। উজ্জ্বল রঙের মুখোশ, রঙিন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন কর্মীরা। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে দোয়েল চত্বর, টিএসসি মোড় প্রদক্ষিণ করে জাতীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয় র‌্যালি। বিভিন্ন বয়সী কর্মীর এই মিলনমেলা সম্পর্কে উদীচী সভাপতি কামাল লোহানী বলেন, দুই বছর পর সারা দেশের কর্মীরা একত্রিত হয়েছেন। সে আনন্দটাই এখানে প্রকাশিত হচ্ছে। সম্মেলনের পাশাপাশি নিজেদের মতো করে উদ্যাপনের একটি ব্যাপার থাকে। কর্মীরা তাদের মতো করেই উদ্যাপন করছেন। নিজেদের মধ্যকার এই আদানপ্রদান উদীচীর ভবিষ্যতের যাত্রাকে আরও সুন্দর-বাধাহীন করতে ভূমিকা রাখবে। মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উদীচীর যে লড়াই, তাতে নতুন করে উদ্দীপনা যোগাবে কর্মীদের এই সম্মিলন। উদীচীর তরুণ কর্মীদের পক্ষে কংকন নাগ বলেন, উদীচীর জাতীয় সম্মেলন সব সময়ই আনন্দঘন মিলনমেলায় পরিণত হয়। প্রাণের টানে দূর- দূরান্ত থেকে কর্মীরা ঢাকায় আসেন। এর অন্যতম উদ্দেশ্য- একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাত। ভাবনার আদানপ্রদান। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও তাই আমাদের উচ্ছ্বাস থামেনি। এদিকে, প্রথম দিনের মতো আজ শনিবার সকাল দশটা থেকে শুরু হবে নানা আনুষ্ঠানিকতা। দিনব্যাপী সাংগঠনিক নানা কার্যক্রম শেষে আগামী দু’বছরের জন্য নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে। অনুষ্ঠিত হবে শপথ গ্রহণ। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। চিরায়ত লোকসংস্কৃতির নানা পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসবে উদীচীর সিলেট, খুলনা এবং রংপুর বিভাগের শিল্পীরা। থাকবে সোহানা আহমেদের একক সঙ্গীত ও শাহাদাৎ হোসেন নিপুর একক আবৃত্তি। এভাবে শেষ হবে দুই দিনের মিলনমেলা।
×