ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে লক্ষ্য ফাইনাল

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে লক্ষ্য ফাইনাল

রুমেল খান ॥ ‘জাপান অনুর্ধ-২১ দলের বিরুদ্ধে আমরা ভালই খেলেছি। জানতাম ওদের সিনিয়র দল বিশ্বে ৫৩ ও এশিয়াতে ১ নম্বর দল। ৬০ মিনিট পর্যন্ত ওদের আটকে রাখতে পেরেছি। কিন্তু ওদের ক্ষিপ্রতা, গতি আর টানা ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতার কারণে শেষের দিকে আর পারিনি। আমরা যদি ওদের মতো দীর্ঘমেয়াদে ক্যাম্প করি ও চেষ্টা করি তাহলে অবশ্যই এর চেয়ে ভাল রেজাল্ট করতে পারব’Ñ কথাগুলো রাসেল মাহমুদ লিটনের। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলের হয়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলে স্বীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে চলে এসেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন ক্যারিয়ারের শুরু, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় হচ্ছেন লিটন। টাঙ্গাইলে জন্ম ১৯৯৪ সালের ৩০ নবেম্বর। সেখানেই পড়াশোনা ও বড় হওয়া। বাবা লুৎফর রহমান ভুইয়া নায়েক সুবেদার (অব) ছিলেন সেনাবাহিনীতে। মা গৃহিণী মনোয়ারা বেগম। ‘বাবা শুরুতে চাননি আমি ফুটবলার হই। আমার জেদের কারণে পরে তিনি মেনে নেন।’ সখীপুর মুজিব ডিগ্রী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করা লিটন ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও ভাল খেলতেন। অলরাউন্ডার ছিলেন। টাঙ্গাইল প্রথম বিভাগ লীগেও খেলেছেন। ফাইভে পড়ার সময় খেলা শুরু করলেও লিটনের ক্যারিয়ার শুরু আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্ট থেকে। তখন তিনি পড়েন টাঙ্গাইল সখীপুর থানার পিএম পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস সিক্সে। ওই সময় থেকেই বুট পড়ে খেলা শুরু। বড় চাচাত ভাই সাদেক তখন এলাকায় খেলতেন গোলকিপার হিসেবে। তাঁকে দেখেই গোলরক্ষক হওয়ার বাসনা জাগে। তাঁকে দেখেই সবকিছু শেখা। ক্লাসভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতা হতো, সেখানে ভাল করার সুবাদেই স্কুলের মূল দলে ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পান। ‘ওই সময় স্কুলের স্যাররা আমাকে ক্যাপ্টেন্সি দিতে চাইলে বেশি চাপ পড়ে যাব ভেবে ক্যাপ্টেন্সি নিতে চাইনি।’ এরপর ক্লাস সেভেনে উঠে টাঙ্গাইল শহরে চলে যান। সেখানে কোচ আতিকুর রহমান জামিলের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। ওখানে পাইওনিয়ার ফুটবলে খেলেন ২০০৮-০৯ মৌসুমে। এরপর সুযোগ আসে ঢাকায় এসে খেলার। তৃতীয় বিভাগের দল ফ্রেন্ডস সোস্যাল ওয়েল ফেয়ারে খেলেন (যদিও কোন ম্যাচ খেলা হয়নি)। ২০০৯ সালে যোগ দেন ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবে। এরপর তৃতীয় বিভাগের দল নবাবপুর ক্রীড়াচক্রে খেলেন। সেখানে ভাল খেলার সুবাদে নজর কাড়েন বাফুফের। ২০১১ সালে ডাক পান অনুর্ধ-জাতীয় ১৯ দলে। ওই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এএফসি অনুর্ধ-১৯ বাছাইপর্বের খেলা। তাতে বাংলাদেশের হয়ে ৪টি ম্যাচেই অংশ নেন লিটন (প্রতিপক্ষ ওমান, মালদ্বীপ, ইরাক ও সৌদি আরব)। কোচ ছিলেন মেসিডোনিয়ার নিকোলা ইলিয়েভস্কি। ওই বছরই যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। দুর্ভাগ্যবশত এখানেও কোন ম্যাচ খেলানো হয়নি লিটনকে। তখনই বাফুফের অধীনে জাতীয় দলের যে চারটি দল করা হয়, সেই দলগুলোর একটিতে (সাদা দল) খেলেন। এরপর ২০১২-১৩ মৌসুমে অফার পান বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলার। এখানে ছিলেন সুপারস্টার গোলরক্ষক আমিনুল হক। আমিনুলকে হটিয়ে একাদশে খেলা অসম্ভব, এটা জেনেও লিটনের মুক্তিতে যোগ দেয়ার কারণ একটাইÑ আমিনুল তাঁর আদর্শ! প্রথম মৌসুমে তাই হলো। একটা ম্যাচেও খেলতে পারলেন না লিটন। কিন্তু দ্বিতীয় মৌসুমেই এলো অধরা সুযোগ। ২-৩টি ম্যাচ খেলে সেই যে ইনজুরিতে পড়লেন, পুরো মৌসুম আর খেলতেই পারলেন না আমিনুল। ফলে খেলার সুযোগ পেয়ে গেলেন লিটন। খেললেন দাপটের সঙ্গেই। ফেডারেশন কাপে রানার্সআপ এবং লীগে মুক্তিযোদ্ধা হলো তৃতীয়। এখন পর্যন্ত এটাই লিটনের সেরা সাফল্য ক্লাব পর্যায়ে। মুক্তিযোদ্ধার হয়ে খেলার সময়ই জাতীয় দলে ডাক পান লিটন। খেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে অনুষ্ঠিত ইনচন এশিয়ান গেমসে। দেশের বাইরে এটাই প্রথম বিদেশ সফর লিটনের। দলের হয়ে প্রতিটি ম্যাচই খেলেন তিনি। দেশেও এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি ম্যাচগুলোর প্রতিটি ম্যাচই খেলেন। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৯টি। ‘প্রথম বিদেশ সফরে খাওয়া-দাওয়া, আবহাওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমার এক পরিচিত ভাই সজীব থাকেন ইনচনে। উনি আমাকে ওখানকার সবকিছু সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়াতে আর কোন সমস্যা হয়নি।’ চলতি মৌসুমে তিনি দলবদল করেছেন। যোগ দিয়েছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডে। রাসেলে তো মামুন খানের মতো জাতীয় দলে খেলা আরেক গোলরক্ষক মামুন খান আছেন। তাঁর কারণে রাসেলের ম্যাচগুলোতে খেলার সম্ভাবনা কতটা? ‘অবশ্যই মামুন ভাই অনেক সিনিয়র ও অভিজ্ঞ প্লেয়ার। তবে মূল একাদশে ঠাঁই করে নিতে আমিও আপ্রাণ চেষ্টা-পরিশ্রম করব। বাকিটা আল্লাহ্র হাতে।’ ক’দিন আগে জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচে ৫-৬টি দুর্দান্ত সেভ করে দারুণ প্রশংসিত হন লিটন। ‘সতীর্থ গোলরক্ষক হিমেল ও শহীদুল ভাই আমাকে বাহবা দিয়েছেন। আমার পরিচিত সবাই অনেক প্রশংসা করেছেন।’ জাতীয় দলের অপর দুই গোলরক্ষক মাজহারুল ইসলাম হিমেল ও শহীদুল আলমকে টপকে মূল একাদশে নেমে সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ ম্যাচ খেলা প্রসঙ্গে লিটনের ভাষ্যÑ ‘এ নিয়ে আমাদের তিনজনের মধ্যে মোটেও কোন দ্বন্দ্ব নেই। তাঁরা তো দু’জনেই আমাকে অনেক ভালবাসেন, পরামর্শ ও উৎসাহ দেন। প্র্যাকটিসে ভুল ধরিয়ে দেন। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, তবে সেটা ইতিবাচক।’ আমিনুল হক ও বিপ্লব ভটাচার্য্য দু’জনেই অবসর নিয়েছেন জাতীয় দল থেকে। কিন্তু তাঁদের অভাব পূরণ হয়নি এখনও। ‘বিপ্লব ভাইও অনেক বড়মাপের গোলকিপার, তবে আমার স্বপ্ন আমিনুল ভাইয়ের মতো গোলকিপার হওয়া। মুক্তিযোদ্ধায় খেলাকালীন আমিনুল ভাই আমাকে অনেক টিপস দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। এগুলো আমার জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।’ জাপান-বাংলাদেশ ম্যাচ গ্যালারিতে এসে দেখেছেন বাংলাদেশের এক সময়ের মাঠকাঁপানো গোলরক্ষক মোহসীন। তিনি লিটনের খেলা দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন। এটা লিটনের কানে গেলে তিনি মোহসীনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও পারেননি। কানাডাপ্রবাসী এই গোলরক্ষকের সঙ্গে ভবিষ্যতে দেখা হলে তাঁর কাছ থেকে কিছু টিপস নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন লিটন। সাবেক ডাচ্ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফকে আসন্ন বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের জন্য আবারও ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে লিটন বলেন, ‘ক্রুইফ এলে মন্দ হবে না। কেননা তিনি আমাদের ভাল জানেন।’ জাতীয় দলের ক্যাম্প কখনই বেশি সময় ধরে করা যায় না। এর কারণ ক্লাবগুলোর আপত্তি। এ নিয়ে ক্লাবগুলোর সঙ্গে বাফুফের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে আসা উচিত বলে মনে করেন লিটন। সামনেই ফেডারেশন কাপ। নতুন ক্লাব শেখ রাসেলের টার্গেটটা কী? ‘এবার রাসেল অনেক শক্তিশালী দল গড়েছে। আছেন এমিলি, জাহিদ, মিশু, মিঠুন, রেজা, হেমন্ত, তপুভাইসহ জাতীয় দলের ৭ জন আছে। আগের দু’জন বিদেশী প্লেয়ার আছে। আশা করি আমরাই চ্যাম্পিয়ন হব’- লিটনের আশাবাদ। তিনি জানান, এ জন্য বিকেএসপি ও বুয়েট মাঠে অনুশীলন ক’দিন পরই শুরু করবে রাসেল। স্মরণীয় ম্যাচ? ‘এবার এশিয়ান গেমসে হংকংয়ের সঙ্গে আমরা ২-১ গোলে হেরে যাই। ম্যাচটা আমরা জিততে পারতাম। কিন্তু ডিফেন্সের ভুলে দুটো গোল খেয়ে হেরে যাই। সে দিন পুরো টিম দারুণ খেলেছিল। এ হারে সে দিন সাংঘাতিক কষ্ট পেয়েছিলাম।’ আসন্ন বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রসঙ্গে লিটন বলেন, ‘লক্ষ্য থাকবে ফাইনাল খেলার। তবে এ জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, বিদেশী দলগুলোও বেশ শক্তিশালী। তাদের কারও সঙ্গেই সম্ভবত আমি আগে খেলিনি। তবে নিজেদের মাঠে খেলব বলে আমরা যে সুবিধা পাব, তা কাজে লাগাতে হবে।’ গোলরক্ষকরা ৬ ফুট হলে তারা বাড়তি সুবিধা পান। লিটনের উচ্চতা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। এ প্রসঙ্গে লিটন বলেন, ‘কম উচ্চতা নিয়ে ভাল গোলকিপার হওয়া যায়। যেমন মোহসীন ভাইও ছিলেন কম উচ্চতার।’ একজন ভাল গোলরক্ষক হওয়ার জন্য কী ধরনের গুণাবলী থাকা উচিত? ‘চারিত্রিক-মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলাপরায়ণ, বিনয়ী, কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে।’ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা কী? ‘জাতীয় দলে খেলতে চাই লম্বা সময় ধরে। বিদেশের কোন ক্লাব অফার দিলে খেলার ইচ্ছে আছে। ওখানে খেলে প্রমাণ করতে চাই বাংলাদেশের প্লেয়াররাও ভাল খেলতে পারে। ভবিষ্যতে খেলা ছাড়লে ফুটবল সংগঠক হওয়ার ইচ্ছে আছে। নিজের এলাকায় ফুটবল একাডেমি করার ইচ্ছে আছে।’ সিলেট ফুটবল একাডেমি চালু হওয়া প্রসঙ্গে লিটনের ভাষ্য- ‘এটা বাফুফের খুবই ভাল উদ্যোগ। সবকিছু ঠিকমতো চললে এখান থেকেই জাতীয় দলের জন্য ভবিষ্যতের প্লেয়াররা তৈরি হবে। পাইপলাইনে পর্যাপ্ত প্লেয়ার থাকবে।’ বাফুফের ভিশন-২০২২ প্রসঙ্গে অভিমত কী? ‘সালাউদ্দিন ভাইয়ের এই স্বপ্নকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে চাই। যদিও লক্ষ্যপূরণ করা খুব কঠিন। কিন্তু চেষ্টা করলে অন্তত এর কাছকাছি পৌঁছা যাবে। বিশ্বকাপে খেলতে না পারলেও এশিয়ার সেরা দশ দলগুলোর মধ্যে থাকলেও মনে করব অনেক অগ্রগতি হয়েছে।’
×