ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খালেদা-তারেকের মন্তব্যে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খালেদা-তারেকের মন্তব্যে তোলপাড়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ তারেক জিয়ার পর খোদ বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়া বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশে এতসব সমস্যা থাকতে মা ও পুত্রের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একের পর বিরূপ মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন- এ রহস্যের কূলকিনারা শুধু দেশের রাজনৈতিক দল বা সুশীল সমাজই নয়, বিএনপির নেতারাও করতে পারছেন না। তবে রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে মন্তব্যকে উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে করছেন। তাঁদের মতে, খোদ পরাজিত শত্রু পাকিস্তান যে কথা কখনও বলেনি, বিজয়ের মাসে হঠাৎ করেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুখে সেসব কথার পেছনে অবশ্যই রহস্য রয়েছে। একদিকে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে না পারার ব্যর্থতা আর ক্রমশঃ জনসমর্থনহীন হয়ে পড়ার বেদনার পাশাপাশি আগামী ৫ জানুয়ারির সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে দেশের সাম্প্রদায়িক-উগ্র জঙ্গীগোষ্ঠী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে উস্কানি দিতেই পরিকল্পিতভাবে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন মিথ্যাচার করা হচ্ছে। অনেকের মতে, জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গীগোষ্ঠী ছাড়া বিএনপি আন্দোলন করে সরকারের কিছুই করতে পারবে না, সেটি বুঝতে পেরেই ওই গোষ্ঠীকে নতুন করে কাছে টানতে স্বাধীনতার মীমাংসিত ইস্যুকে নতুন করে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার চেতনাকে আক্রমণ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তব্য অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক। বর্তমান সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হচ্ছেন এবং স্বাধীনতার সুফল দেশের জনগণ পাচ্ছেন। যখন মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস উঠে আসার মাধ্যমে দেশের নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার খুনী চরিত্র, ক্ষমতার লোভ, সাম্প্রদায়িক-জঙ্গী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের চরিত্র প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে- ঠিক তখনই পাকিস্তানের এজেন্ট হয়েই খালেদা জিয়ারা তার স্বামীকে বাঁচাতেই মুক্তিযুদ্ধকে খাটো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে অপমানিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর মিথ্যাচারে দেশের প্রকৃত ইতিহাসের ওপর সামান্যও আঁচড় পড়বে না। বরং খালেদা-তারেকের উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তিকর ইতিহাস বিকৃতির চরম মিথ্যাচার দেখে দেশের জনগণই তাদের করুণা করবে। অবিলম্বে মিথ্যাচার বন্ধ না করলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে সব সত্য কথা বলে দেব। রবিবার রাজধানীর বিএনপিপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া দাবি করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের রণাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কোন ভূমিকা ছিল না। এমন দাবি ছাড়াও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা অভিনব ও বিতর্কিত মিথ্যা ইতিহাস তুলে ধরেন সাবেক দু’বারের এই প্রধানমন্ত্রী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করে পুত্র তারেক রহমানের ধৃষ্টতাপূর্ণ ও ঔদ্ধত্যমূলক বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে চলা নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়ের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার খোদ খালেদা জিয়ার কণ্ঠে চরম ইতিহাস বিকৃতির অভিনব তথ্য শোনার পর দেশের স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনীতিতে আমাদের কাছে সকল ক্ষেত্রে পরাজিত খালেদা জিয়া ও তার পুত্র এখন উ™£ান্ত ও বিকারগ্রস্ত হয়ে ইতিহাস বিকৃতির সকলসীমা লঙ্ঘন করে চলেছেন। তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার স্বামী অস্ত্রহাতে দেশের কোন জায়গায় যুদ্ধ করেছেন? আপনার স্বামী কোন সরকারের অধীনে বেতন নিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, ট্রেনিং, অস্ত্র সংগ্রহ এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় করেছে। তিনি বলেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে হানাদার জানজুয়াদের আতিথেয়তায় কাটিয়েছেন, সেই খালেদা জিয়ার মুখে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা মানায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কী বিএনপির জন্ম হয়েছিল? আর জিয়া ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডারমাত্র, আবার তাঁর কর্মকা-ও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাই দেশবাসী বিকারগ্রস্ত মা-বেটার এমন মিথ্যাচারের ইতিহাস শুনে তাদের করুণাই দেখাবে। রাজনীতিতে যেমন খালেদা জিয়া সবক্ষেত্রে আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছে, মিথ্যাচার বন্ধ না করলে আগামীতে রাজনীতি থেকেই তাঁরা হারিয়ে যাবেন। খালেদা জিয়ার বিতর্কিত ও অভিনব বক্তব্য শুনে বেশ ক’জন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে শত শত মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেলাল মোরশেদ বীরবিক্রম বলেন, একাত্তর সালে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা যেভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করত, অপপ্রচার চালাত- ঠিক একই কায়দায় একই কাজ শুরু করেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। না হলে জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা লাগাতার আন্দোলন শুরু করবে। ‘ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করা হবে’-খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের জবাবে বিভিন্ন দলের নেতারা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোন ভূমিকা না থাকলে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে যে তালিকা করেছিলেন তাঁর ৯০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই আওয়ামী লীগের কেন? বাকি ১০ ভাগের মধ্যে বেশিরভাগই সিপিবি, ন্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য দলের। বিএনপির তো তখন জন্মই হয়নি। খালেদা জিয়া যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চরম মিথ্যাচার করেছেন, খালেদা জিয়ার সময় তৈরি তালিকাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ক্ষোভ প্রকাশ করে সুশীল সমাজের একাধিক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটি অমোঘ সত্য ইতিহাস। আর জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মাত্র। কিন্তু মেজর জিয়া একদিনের জন্যও বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করে সরাসরি কোথাও অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি। সেক্টর কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহ, কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, মেজর খালেদ মোশাররফ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করলেও মেজর জিয়া তখন ভারতের মাটিতেই অবস্থান নিয়ে ছিলেন। খালেদা জিয়া ওই সময় ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন বলেই এসব সত্য ইতিহাস তাঁর অজানা। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ তারেক রহমানকে ফেরারি আসামি ও নষ্ট মায়ের নষ্ট ছেলে বলে আখ্যায়িত করে বলেন, তারেক রহমান দেশে না এসে বিদেশের মাটিতে বসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন। রাজনীতি করতে চাইলে তাকে দেশে এসে আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এদিকে সোমবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গণমাধ্যম উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার জন্য জিয়াউর রহমান তাঁর স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে কয়েকবার লোক পাঠালেও খালেদা জিয়া আসেননি। উনি পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য স্বামীর সঙ্গে যাননি। তাই পরবর্তীতে দেশ যখন স্বাধীন হলো, স্ত্রীর অবাধ্যতার জন্য জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ হলেন। খালেদা জিয়ার পরিবার টিকছিল না। বঙ্গবন্ধু নিজে খালেদা জিয়ার হাত জিয়ার হাতে তুলে দিয়ে পরিবার রক্ষা করেন। অথচ ১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালন করে খালেদা জিয়া তারই প্রতিদান দিচ্ছেন।
×