ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকার দিনরাত

বিজয়ের গল্প শিশুদের জিজ্ঞাসা ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকার রাজপথ ছিল আনন্দমুখর। দলে দলে মানুষ বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন আয়োজনে যোগ দিতে। সপ্তাহের মাঝখানে একটি ছুটির দিন পেয়ে অল্পবয়সীরা বন্ধুবান্ধবসহ মেতে উঠেছিল হাসিঠাট্টায়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যারা বিশেষ জানে না তাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছিল গানে-গল্পে-আড্ডায় মেতে ওঠার পাশাপাশি বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে কিছু জেনে নেয়ার। যারা অক্ষরজ্ঞানহীন যুবাবয়সী মানুষ কিংবা দরিদ্র ঘরের শিশু-বালক-বালিকা তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প খুব অল্প কথায় সহজ করে কিভাবে পৌঁছাতে পারিÑ তা নিয়ে নিশ্চয়ই বিজ্ঞজনরা ভাবেন। আমার নিজের চোখে দেখা এবারের একটি ঘটনা চোখ খুলে দিয়েছে। এভাবেও সম্ভব একাত্তরের ইতিহাস গল্পচ্ছলে তুলে ধরা এবং একইসঙ্গে সামাজিকভাবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যের বিলম্বিত বিচারকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। পথের মোড়ে পান-সিগারেটর দোকান। ঠিক সস্তা দোকান নয়, বিদেশী আট-দশ রকমের সিগারেটে ভরপুর। দোকান মালিক খুব বেশি হলে মাঝ তিরিশের কোঠায় হবেন। পাশে তার বালকপুত্র বসা। এক ভদ্রলোক সিগারেট ধরাতে ধরাতে হঠাৎ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কপালে পতাকার ছবিঅলা ব্যান্ড। এটা কেন বেঁধেছ? পুত্র মিষ্টি হেসে উত্তর দিল, ‘আইজ স্বাধীন দিবস’। এটা কারু কাছ থেকে হয়ত সে শুনেছে। ক্রেতার পরের প্রশ্নের উত্তর আর দিতে পারল না ছেলেটি। বাবা বললেন, ‘ও বাচ্চামানুষ কেমনে জানবে কার লগে কার যুদ্ধ হইছিল।’ অগত্যা আমিই বলে উঠলাম, আপনি জানাবেন। ক্রেতা ভদ্রলোক সায় দিলেন আমার কথায়। বললেন, শোনো বাবু, পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখেছ? ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় দিল। ভদ্রলোক এবার বললেন, পাকিস্তানী মিলিটারি আমাদের দেশে এসে দেশটাকেই যেন দখল করে নিয়েছিল; আমাদের বহু মানুষকে মেরে ফেলেছিল। আমরা ওদের সঙ্গে লড়াই করলাম। ওরা হেরে গেল। এই ষোলোই ডিসেম্বরে ওরা হার মেনেছিল। তাই আজ আমাদের বিজয় দিবস। আমরা আনন্দ করি। এই আনন্দ করতে পারছি আমাদের ত্রিশ লাখ মানুষকে হারিয়ে। এবার দোকানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি এত মানুষ! বোঝা গেল, তরুণ পিতাটিও অনেক কিছুই জানেন না। জানলেও সংশয় রয়েছে। তারপরও নিজে থেকেই বললেন, ‘আমাদের বাঙালীরাও ওদের সাহায্য করছিল।’ বললাম, হ্যাঁ, রাজাকাররা পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের দেশের মানুষকে মেরেছে। বহু মা-বোনকে অপমান-নির্যাতন করেছে। ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। তাই তো আজ আমরা তাদের বিচার করছি। একজন একজন করে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছি। শিশুটি হা করে আমাদের কথা শুনছিল। কয়েক মিনিটের আলাপ। অথচ এর ভেতর দিয়ে পিতা-পুত্র দু’জনেই নতুন কিছু জানতে পারল। ভাবলাম, স্কুলের আনুষ্ঠানিক পাঠদানের চাইতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এমন সাধারণ আলাচারিতার মাধ্যমেও তো ইতিহাস বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা সম্ভব। ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমেও পর্দায় সহজ অথচ কার্যকরভাবে বাচ্চাদের জানানো যায় একাত্তরের কাহিনী। বড় বড় বর্ণাঢ্য আয়োজনের পাশাপাশি ছোট ছোট এজাতীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা আমরা ভাবতেই পারি। পথে পথে কুশ্রিতা আমাদের এক বন্ধু দশ বছর পর দেশে ফিরে আফসোস করে বলেছিল, ঢাকার রাস্তায় হাঁটা যায় না কেবল মলমূত্রের দুর্গন্ধে। সত্যিই তো! মলভা-ের ওপর আমরা বিকাশ করে চলেছি এক আজব শহরের। বিকশিত হয়ে চলেছে নরকনগরী। নরকবাসী রা কাড়বেন কবে? চলতি পথে চোখ খোলা রাখলেই দেখবেন নর্দমার পাশে কিংবা দেয়ালের সামনে কিংবা একটা একলা গাছকে অবলম্বন করে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করছেন। এই কুশ্রিতা দেখে দেখে হয়ত অনেকেরই চোখ সয়ে গেছে, কিন্তু এটা কত বড় অসভ্যতা তা কে কাকে বলে দেবে! এটা ঠিক যে, ঢাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়নি। যে শহরে খুব বেশি হলে দশ লাখ মানুষের বসবাস করা সমীচীন সেখানে কয়েক কোটি মানুষ বসবাস করলে কীভাবে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব? যত যুক্তিই আমরা কপচাই না কেন, রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে হুটহাট দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপ খুলে কিংবা লুঙ্গি তুলে মূত্র ত্যাগ করতে দাঁড়িয়ে বা বসে যাওয়ার মতো গর্হিত কাজকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। লোকটিকে লজ্জা দেয়া কর্তব্য। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী; তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে কোন ধরনের নির্লজ্জতা বা অসভ্যতা তো করছেন না! তা হলে পুরুষ বলেই কি অধিকার জন্মে যায় যেখানেসেখানে শত শত চোখের সামনে পেচ্ছাব করার? এই কুৎসিত দৃশ্য একটি শিশু কিংবা নারীর ওপর কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে তা কি আমরা একটিবারের জন্যও ভেবে দেখছি? আর শুধু সভ্যতা-ভব্যতার কথাই বা কেন বলছি, এতে পরিবেশ দূষণও হচ্ছে মারাত্মক। এই বিচ্ছিরি অভ্যাস থেকে কী করে আমরা মুক্ত হতে পারি? না, পুলিশ দিয়ে জরিমানা করে এটা করা যাবে না। এই লেখা যারা পড়ছেন তারা ওই কাজটি আর করবেন না, এটা ভেবে নিতে ভাল লাগছে। অন্তত একটিবারের জন্য থমকে যাবেন কাজটা করতে গিয়ে। আচ্ছা, বাইরে বেরুনোর আগে কাজটা সেরে নিলেই তো হয়। এই সামান্য সতর্কতাটুকু আমরা কেন মেনে চলি না? পথেঘাটে যত্রতত্র লজ্জাকর ওই দৃশ্য দেখলে আমরা সমস্বরে যদি ছিঃ ছিঃ বলে লজ্জা দেবার চল শুরু করতে পারি, তা হলে প্রাথমিকভাবে অসভ্য দর্শনের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগের অন্তত সূচনা হয়। বিষয়টি পাঠকদের ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। তাছাড়া এলাকাবাসীরও যে দায়িত্ব রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেকে মানবেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ধানম-ির আবাহনী মাঠের পেছনদিক দিয়ে হেঁটে ছায়ানট ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম শুদ্ধসঙ্গীত শুনতে। হঠাৎ তীব্র গন্ধে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় চলে আসতে বাধ্য হই। মাঠটার পেছনের দেয়াল ঘেঁষে রীতিমতো ‘বৃষ্টি’ হয়ে গেছে। ফুটপাথ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই দুর্গন্ধময় ধারা প্রধান সড়কে চলে এসেছে। এটা খোলা গণশৌচাগার নাকি? এসব দেখার কি লোক নেই? একটা মজার বাক্য মাথায় এসে গেল। অনেকেই জানেন সেটা। যতিচিহ্ন কী বিপদ ঘটিয়েছিল, মনে পড়ছে? ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে জরিমানা হবে!’ গু-ার মতো হোন্ডা চলে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক, মানে যেখানে বিভিন্ন গতিবেগের বিচিত্র যান চলে সেখানে তো বটেই, এমনকি পথচারীর চলাচলের জন্য সরু ফুটপাথেও দেদার চলছে মোটরবাইক। বেশিরভাগ চালক মানছেন না ট্রাফিক আইন। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না মোটরসাইকেলের গতি। তারস্বরে চিৎকার করে অর্থাৎ অতি উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে পথ চলেন তাঁরা। অনেকে বাধ্যতামূলকভাবে হেলমেট পরার নিয়মকেও বুড়ো আঙুল দেখান। খবরের কাগজে বউবাচ্চাসমেত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট গোটা পরিবারের বিপজ্জনকভাবে মোটরসাইকেল আরোহণের ছবি ছাপা হয়ে থাকে মাঝেমধ্যে। কোন ভ্রুক্ষেপই নেই চালকের। পথচারীর জন্য সবচেয়ে বিড়ম্বনা ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন একজন চালক সাঁ করে তার মোটরসাইকেল ফুটপাথের ওপর তুলে দেন। রাস্তার ওপর চলমান গাড়ির সারিকে বাইপাস কিংবা ওভারটেক করার নব্য এই তরিকায় চালক মুহূর্তের সুবিধা নেন। তার কিছুটা সময় হয়ত বাঁচে, কিন্তু তাতে পথচারীর হাড়মাংস যে বাঁচে না! এর সমান্তরালে রয়েছে উল্টোপথে বা রং সাইডে মোটরসাইকেল চালানোর স্বেচ্ছাচারী মনোভাব। ফলে নিত্য দুর্ঘটনা ঘটছে। আমার চেনা দুই ব্যক্তি গত সপ্তাহে আহত হয়েছেন। একজন দুমুখো চলাচলের রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বাম থেকে ডানদিকের রাস্তায় যাবেন তিনি জেব্রাক্রসিং দিয়ে। যথানিয়মে ডানদিকের যান চলাচলের ওপর দৃষ্টি ছিল তাঁর। দেখে দেখে পার হচ্ছিলেন তিনি সতর্কতার সঙ্গেই। ওই সময় উল্টোমুখী অর্থাৎ রং সাইডে একটি হোন্ডা চলে এলো গু-ার মতো ফুঁসতে ফুঁসতে। মুহূর্তে ধাক্কা দিল সেই আরোহীকে। রাস্তার ওপর পড়ে গেলেন তিনি। ভদ্রলোক জ্ঞান হারাননি। বুঝলেন হাড়গোড় তার ভাঙ্গেনি। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল, মোটরসাইকেল আরোহীকে তখন গণপিটুনির হাত থেকে কে রক্ষা করে? দুর্ঘটনাকবলিত সেই ভদ্রলোকই অন্যদের মিনতি করে বললেন লোকটিকে ছেড়ে দিতে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলেন হো-াঅলা। কিন্তু পরদিন দুর্ঘটনার শিকার পথচারীকে যেতে হলো মাথার সিটিস্ক্যান করাতে। অপর ঘটনাটি ফেসবুকের কল্যাণে জেনেছি। পায়ে ব্যান্ডেজ করা কবির ছবি পোস্ট করা হয়েছে। নিচের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে : ‘জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা গতরাতে (১৮ ডিসেম্বর) আজিজ সুপার মার্কেটের কাছে কতিপয় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্ত দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। তার ডান পায়ের গোড়ালির নিচে কয়েকটি সেলাই পড়েছে।’... এসব দেখেশুনে ক্ষেপে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, পুলিশ ভাইরা এই মহানগরীর নাগরিকদের ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারের শিক্ষা দিলেন ক’দিন আগে। বেশ ভাল কথা। এবার জরুরীভিত্তিতে বেপরোয়া হো-াচালকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করুন। বাংলা আমার অহঙ্কার বিজয়ের মাসে কত ধরনেরই না সৃষ্টিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নবীন-তরুণদের ভেতর উদ্যম-উদ্দীপনা জাগে। বাংলাদেশী ফটোগ্রাফার্স গ্রুপ (বিডিপিজি) মূলত তরুণ আলোকচিত্রীদেরই সংগঠন। গত বছর থেকে সংগঠনটি কাজ করছে। ইতোমধ্যে চারটি অনলাইন এবং একটি প্রিন্টেড আলোকচিত্র প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেছে। শুক্রবার ছিল সংগঠনটির ‘বাংলা আমার অহঙ্কার’ শীর্ষক দ্বিতীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চতুর্থ তলায় পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রীদের সঙ্গে সংগঠনের অন্যান্য আলোকচিত্রী জমিয়ে গল্প করছিলেন। চলছিল সেলফি তোলার হিড়িক। সারা দেশের তিন শতাধিক আলোকচিত্রীর তোলা ছবিমালা থেকে অর্ধশত ছবি প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। সাদাকালো ও রঙিন দু’ধরনেরই ছবি আছে প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিচিত্র ধরনের প্রাণীর ছবি তো রয়েছেই এ প্রদর্শনীতে। আরও আছে মানুষের কর্মমুখরতার চিত্র। সব মিলিয়ে নিজের দেশকে ভালবাসার মতো নজরকাড়া কিছু নান্দনিক উপাদান। পাঁচটি ছবিকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফাররা দেয়ালে ঝোলানো নিজের ছবির পাশে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগ হারাননি।
×