ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব বনাম বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:১১, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বিশ্ব বনাম বাংলাদেশ

রেখাচিত্রের মূল্য নির্দেশক রেখাটি নামছে। বছরখানেক ধরেই নামছে। অবিশ্বাস্য রকমে নেমে যাচ্ছে। একবারের জন্যও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তেলের মূল্য নির্দেশক রেখাটির কথাই বলছি। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে যে রেখাটি ১২২ ডলারে অবস্থান করছিল, তা এগারো মাসের মাথায় নেমে আসে ৫৭.৮১ ডলারে। কমেছে ধারাবাহিকভাবেই। দ্বিগুণেরও বেশি তেলের দাম কমে গেছে এক বছরে। এই কমার পেছনে আছে কোন কোন দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, আবার কোন দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে যায়, অর্থনীতির সেই চিরাচরিত সূত্রের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। তেলের উৎপাদন বাড়ছে, চাহিদার তুলনায় বেশিই হচ্ছে। ফলে দাম কমছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেল অয়েল দাম কমার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক। দেশটি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শেল অয়েলের উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে সমর্থ হয়েছে। তারা ব্যারেল প্রতি ৫০ ডলার করেও যদি তেল রফতানি করে, তবু মুনাফা অর্জন করবে। এবং সেই কারণে শেল অয়েলের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে। এই বিস্তারকে ঠেকাতেই এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওপেকভুক্ত দেশগুলোও কমাচ্ছে তেলের দাম। আবার কেউ কেউ বলছেন, ইরানকে বিপদে ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে তেলের দাম কমানো হচ্ছে। ইউরোপের দিকেও আঙ্গুল তুলছেন কেউ কেউ। বলছেন, ইউরোপের ষড়যন্ত্র। তেলের দাম কমে গেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ইউরোপের হোঁচট খাওয়া অর্থনীতি। কেননা, এক হিসেবে দেখা যায়, তেলের দাম দশ শতাংশ কমলে, ইউরোপের অর্থনীতি শূন্য দশমিক এক শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কেউ কেউ বলছেন, রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্যই আন্তর্জাতিক এই ষড়যন্ত্র। রাশিয়ার অর্থনীতির সত্তর ভাগই তেল ও গ্যাসের অবদান। অবরোধের কারণে এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে দেশটি তার ওপর তেলের এই পড়তি দাম যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এই ঘা দেয়ার ষড়যন্ত্ররূপেই তেলের পড়তি দাম। কারণ যাই হোক না কেন, তেলের দাম কমছে, এটাই সত্যি। অবিশ্বাস্য এই পড়তি দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই নিজের দেশের তেলের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছে। ব্যতিক্রম বলতে হবে বাংলাদেশকে। দেশে তেলের দাম একটুও কমেনি। কমার কোন লক্ষণও নেই। বিশ্ব বাজারে ২০০৯ সালে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ৬০ ডলার থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১২২ ডলার হয়েছিল। এই বর্ধিত তেলের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারও চার দফা তেলের দাম বাড়িয়েছিল। ২০১৩ সালে সরকার পেট্রোল ও অকটেনের দাম লিটার প্রতি পাঁচ টাকা বাড়ায় এবং ডিজেল ও কেরোসিন বাড়ায় সাত টাকা করে। তখন বিভিন্ন মহল তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে সমালোচনা করলেও, সরকার যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লোকসানের কথা। বর্ধিত মূল্য তালিকা এবং কোন কোন খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় এমন একটা চার্ট প্রতিটি পেট্রোল পাম্পে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে তেলের দাম কমা শুরু হলেও একবারের জন্যও তেলের দাম কমানো হয়নি। কথিত আছে , এ দেশে যে জিনিসের দাম একবার বারে, তা আর কমে না। তেলের ক্ষেত্রেও যেন সেই অবস্থা! তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের কথা বিবেচনা করা হয়। ভারত তেলের দাম বাড়ালে যেন পাচার না হয়, সেজন্য দেশেও তেলের দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে ভারত তেলের দাম কমাচ্ছে, কিন্তু সরকার এখনও তেলের দাম কমায়নি। যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পুরনো লোকসান পুষিয়ে নেয়ার বিষয়টি বারংবার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। লোকসানে থাকা বিপিসি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। ইতোমধ্যে বিপিসি লাভের ধারায় ফিরেছে। এর অতীতের দায়-দেনাও পরিশোধ হয়ে যাচ্ছে। সরকার থেকে ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিপিসি লাভের ধারায় ফিরুক, এটা সবাই চায়। কিন্তু সর্বাগ্রে চায় দ্রব্যমূল্যর সহনীয় মাত্রা। এ জন্য দরকার বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম কমানো। এটা সময়ের দাবি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তেলের দাম অপরিবর্তনীয় থাকার কথা জানিয়ে বলেছেন , ‘দেশে জ্বালানি তেলের দাম সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করা হয় না। সরকার দীর্ঘদিন থেকে তেলে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। আমরা আমাদের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে দাম মাঝে মাঝে বাড়িয়েছি। কমানোর কোন ইচ্ছাও আমাদের নেই।’ তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছিল। সেইসঙ্গে বেড়েছিল বাড়ি ভাড়া, পরিবহন খরচ। বেড়েছিল শিল্পপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম। তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল সব জিনিসের দাম। এ যেন, দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা! মূল্যস্ফীতি সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছিল মানুষের কাঁধে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড় চলছে। কম দামে আমদানি করা তেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করা হলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদ্যুতের দাম বাড়লে আরেক দফা মূল্যস্ফীতির সেই সিন্দাবাদের ভূত জনগণের ঘাড়ে এমনভাবে জেঁকে বসবে যে, জনগণ মাথা তুলতে পারবে না। সেই ভূতের দৌরাত্ম্য কমাতে বিদ্যুতের দাম কমানো যেমন দরকার, তেমনি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দামও কমানোও দরকারু। তাহলে হয়তো মানুষ একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে।
×