ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

বেপরোয়া কর্মসূচী কাক্সিক্ষত নয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

বেপরোয়া কর্মসূচী কাক্সিক্ষত নয়

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করাটা স্বাভাবিক। জনগণ আশা করবে যে সে আন্দোলন হবে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। গত নির্বাচন নিয়ে সরকারি জোট ও প্রধান বিরোধী জোটের মধ্য বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। বিরোধী জোট দাবি করেছিল যেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। অন্যদিকে সরকারি দল নির্বাচিত সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর মনোভাব আমাদের মধ্যে এখনও জন্মায়নি। দুটি বিবাদমান পক্ষের উভয়েরই লাভ হতে পারে অর্থাৎ ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি আমাদের মাথায় ঢোকে না। ‘হয় আমি জিতবো আর না হয় তুমি’ এমনি আমাদের মনোভাব। অবশ্য কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমি যে হারতে পারি এটা আমার চিন্তাতেই আসে না। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে আমার জয়ের সম্ভাবনা নেই এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজের ক্ষতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করাটাও আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। কথাগুলো মনে পড়ল গত নির্বাচনের কথা মনে করে। বিরোধী জোট মনে করল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবল নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। সরকারি দল মনে করল যে, একটা অনির্বাচিত সরকারের হাতে সরকারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেয়া ঠিক নয়। তারা আরও বলল যে, তাদের দ্বারা নির্বাচনে কারচুপির কোনো ইতিহাস নেই। বিরোধী জোট বলল যে, স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক জিনিস নয়। এমনিভাবে ঝগড়া-বিবাদ বেড়েই চলল। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের খাতিরে দেশের সব ক্ষমতা একটা অনির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেয়ার দৃষ্টান্ত নেই। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে আমাদের সংবিধান ত্রুটিহীন নয়। এজন্য আমরা ভুগেছি। কতদিন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে? একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। সংবিধান মেনেই চালাকি করে যে কোনো রাম-শ্যাম, যদু-মধুকে সরকার প্রধান করা যায়। ইয়াজউদ্দীনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ এর একটা উদাহরণ। যাই হোক, সংবিধান সংশোধন করে সরকার পক্ষ নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিল। বিরোধী জোট সেটা প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত নিল। বাস্তবে সেটা সরকার উৎখাতের আন্দোলন বলে মনে হলো। মনে হয় বিরোধী জোট বিশ্বাস করেছিল যে, দেশী-বিদেশী শক্তিগুলো একত্রিত হয়ে সরকারকে বাধ্য করবে ক্ষমতা ছাড়তে। বাস্তবে তেমনটি হলো না। রণাঙ্গনে পরিণত হলো রাজপথ। বিশাল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলো জাতি। ১৩ নভেম্বর জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত স্বদেশ রায় রচিত একটি প্রবন্ধে এই বিশাল ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র পাওয়া যায়। এই তথাকথিত রাজনৈতিক আন্দোলনে নিহত হন ৫০৭ জন। আহত হন ২২ হাজার ৪০৭ জন। পুলিশ সদস্য নিহত হয় ১৫ জন ও বিজিবি নিহত হন ২ জন। আহতের সংখ্যা ২ হাজার ৪৫৭ জন। রেল গাড়িতে নাশকতা হয়েছে ৩৯৮। বাস পোড়ানো হয়েছে অনেক। গাছ কাটা হয়েছে অসংখ্য। তাদের হাতে বৈদ্যুতিক করাত দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২৩ জনকে। ৫৬৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়েছিল। ৫৫ জন যানবাহন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। ৯০০ মন্দির ও ৮০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করা হয়েছিল ও আগুন লাগানো হয়েছিল। স্বদেশ বাবু নিজ চেষ্টায় এই পরিসংখ্যান পেশ করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সরকারিভাবে সব উৎস থেকে তথ্য যোগাড় করেই ক্ষতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। জাতির অধিকার আছে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান জানার। গত নির্বাচনকে বিরোধী জোট মেনে নেয়নি। তারা আর একটি নির্বাচন দাবি করে আসছে। তারা আন্দোলনের কথা বলে আসছে। আবার সরকার উৎখাতের কথা বলা হচ্ছে। আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে বিরোধী জোটের নেত্রী বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেছেন। এমনি একটি জনসভায় তিনি জনগণকে আহ্বান করেছেন যা কিছু পাওয়া যায় তাই হাতে নিয়ে রাজপথে নেমে আসতে। পুলিশ গুলি চালালে রাজপথে তার মোকাবেলা করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন। বলা যায় একেবারেই যুদ্ধংদেহী মনোভাব। এই অবস্থায় ’১৩ সালের ক্ষয়ক্ষতির কথা আমাদের মনে করতে হবে এবং এজন্যই সরকারী শ্বেতপত্র প্রকাশের অনুরোধ। একটা কর্মসূচী সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পরিস্থিতি ও পটভূমিকার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিরোধী জোটের নেত্রীর মধ্যে একটা ‘মরিয়া ভাব’ দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এর কারণ আছে যথেষ্ট। তাঁর জোটের অনেকেই এখন বলছেন, গত নির্বাচন বর্জন করা ঠিক হয়নি। এই বর্জনের ফলে বিরোধী জোট প্রায় পরিচয়হীন হয়ে পড়েছে। সরকারের দেশ পরিচালনায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যে বিদেশী শক্তির বা শক্তিগুলোর ওপর তাঁর জোটের ভরসা ছিল তারা সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের জনগণ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ হওয়ায় তাঁরা নির্বিঘেœ দৈনন্দিন জীবনযাপন করছেন। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া সব কিছু নির্বিঘেœ চলছে। এই অবস্থায় জোটের নেতাকর্মীরা তাই নির্জীব হয়ে পড়ছে। তাদের চাঙ্গা করতে এক ধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখাতে হচ্ছে নেত্রীকে। একটা দৈনিক পত্রিকায় আলোচিত হয়েছে যে বয়সের কারণে এটিই হয়ত তাঁর শেষ আন্দোলন। কাজেই তিনি বেপরোয়া। তাঁর দুই ছেলে বিদেশে। একজন অলিখিতভাবে দলের একচ্ছত্র নেতা। তিনি ‘রিমোট কন্ট্রোলে’র সাহায্যে দল চালাচ্ছেন। তিনি মাঝে মাঝে জাতির পিতাসহ অন্যান্য বিষয়ে এমন সব মন্তব্য করছেন যাতে কওে তাদের নিজেদের লোকদেরও মধ্যেই সমালোচনা হচ্ছে। জনসাধারণের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আগেরবারের আন্দোলনে জনগণ এগিয়ে আসেনি। ভাংচুর করেছিল প্রধানত জামায়াতের ক্যাডাররা। মনে হচ্ছে এক ধরনের অভিমান আর অবিশ্বাস তাদের পেয়ে বসেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় প্রকাশের সময় এসব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে এবার কি তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে? যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। হয়ত এসব নেহায়েত গুজব। কিন্তু অনেকেই সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার কথা বলছে। এই অবস্থায় এবারে জামায়াতের ক্যাডাররা কতটা ঝাঁপিয়ে পড়বে এ নিয়ে বিরোধী জোটনেত্রী কতটা খোঁজ নিয়েছেন তা আমাদের জানা নেই। যে ধরনের আন্দোলনের কথা জোটনেত্রী বলছেন তাতে রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। একথা তিনি নিজে বলেছেন। কাজেই সবকিছু ভেবে-চিন্তে তিনি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেবেন এটাই জনগণ আশা করে। লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াটিস্টের একজন ফেলো
×