ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৫ জানুয়ারি কি কর্মসূচী নেবে বিএনপি?

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

৫ জানুয়ারি কি কর্মসূচী নেবে বিএনপি?

শরীফুল ইসলাম ॥ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী পালনের কথা আগে থেকে বলে এলেও এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপি। তবে ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপি যা করতে চায় তার মধ্যে রয়েছে প্রথমত, সরকারের অনুমতি পেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বড় সমাবেশ করা। তা না হলে এ দিনটিকে কালোদিবস হিসেবে পালন করতে সারাদেশে কালো পতাকা মিছিল করা। কালো পতাকা মিছিল করার অনুমতি না পেলে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল আর যদি তাও না করা যায় তাহলে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে চান। তবে এখন পর্যন্ত এসব কর্মসূচীর কোনটির ব্যাপারেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি দলীয় হাইকমান্ড। সূত্র মতে, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করার চিন্তা আগে থেকেই করেছিল বিএনপি হাইকমান্ড। এ পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সারাদেশের ১০ জেলায় জনসভা করে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সময়মতো ডাক দিলে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি চেয়েছিলেন ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র বন্দী দিবস হিসেবে উল্লেখ করে সারাদেশ থেকে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের রাজধানীতে জড়ো করে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালন করা। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে সবকিছুর খোঁজখবর নিয়ে সে কর্মসূচী পালন থেকে পিছু হটেন তিনি। তবে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে এখন তিনি কঠোর না হোক অন্তত যেনতেন একটি কর্মসূচী হলেও পালন করতে চান। আর তা করতে গিয়ে যদি ভাল কোন ইস্যু পেয়ে যান তাহলে অন্তত একদিন হরতাল পালন করতে চান। সারাদেশের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে হতাশ হন বিএনপি হাইকমান্ড। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই হামলা, মামলা ও পুলিশী নির্যাতন উপেক্ষা করে এখনই আন্দোলনে শরিক হতে রাজি হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একটি কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে সম্প্রতি ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া বিভিন্নস্তরের কয়েক হাজার সাবেক ছাত্রদল নেতাকে ঢাকায় ডেকে এনে তাদের মতামত নেন খালেদা জিয়া। কিন্তু রাজনৈতিক মঞ্চে গরম বক্তব্য দিলেও তারা কেউই আন্দোলনে শরিক হতে রাজি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এমনকি বিএনপি সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষকে ঢাকায় ডেকে এনে আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানালেও খালেদা জিয়ার এ আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না তারা। দলের থিঙ্কট্যাঙ্ক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও এখনই আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপিকে সায় দিচ্ছে না। আর এ কারণেই ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে বিএনপি শিবিরে হতাশা নেমে এসেছে বলে জানা যায়। গতবছর ২৯ ডিসেম্বর রোড ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই মূলত আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশা নেমে আসে। এই হতাশার কারণেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিরোধ করতে তাদের ভোট কেন্দ্র্রভিত্তিক কর্মসূচীও ব্যর্থ হয়। অপরদিকে এ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকারকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্বীকৃতি দিলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি নেতাকর্মীর প্রতি কঠোর নজরদারি আরোপ করে। তবুও দলীয় হাইকমান্ড নেতাকর্মীকে হতাশামুক্ত রাখতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের পতন ঘটাতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে জেলায় জেলায় জনসভা করতে শুরু করেন খালেদা জিয়া। রাজধানীর বাইরে অন্তত দশটি জনসভার প্রতিটিতেই তিনি সময়মতো আন্দোলনের ডাক দেয়ার কথা বলে উপস্থিত নেতাকর্মীর সম্মতি আছে কিনা জানতে চান। প্রতিটি জনসভায়ই নেতাকর্মীরা ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরবর্তীতে আন্দোলনের ডাকে সাড়া না দিয়ে তারা নিজেদের দলীয় কর্মকা- থেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। আন্দোলনের স্বার্থে বিএনপি নেতাকর্মীর মনোবল চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সময়মতো আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে উল্লেখ করে বলেন, এবার আন্দোলন শুরু করলে সরকারের পতন না ঘটিয়ে তারা রাজপথ ছাড়বেন না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য এ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যতদিন প্রয়োজন রাস্তায় থাকা এবং পুলিশ গুলি চালালে তা রাজপথেই মোকাবেলা করারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন খালেদা জিয়া। বিএনপির বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় হাইকমান্ড যেভাবে আন্দোলন করার কথা বলছেন সে ধরনের আন্দোলন করার কোন প্রস্তুতি এখন সাধারণ নেতাকর্মীর নেই। আর খালেদা জিয়া যদি আন্দোলনের স্বার্থে এখন রাজপথে নামতেও চান তাহলে শেষ পর্যন্ত দলের অধিকাংশ প্রভাবশালী নেতাকেই তিনি পাশে পাবেন না। যে কারণে আবারও গতবছর ২৯ ডিসেম্বরের মতো বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে ব্যর্থ হবে। জানা যায়, পদ-পদবি রক্ষা ও ভবিষ্যতে আরও বড় পদ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অনেকেই আন্দোলনের পক্ষে জোর গলায় বক্তব্য দিয়ে সাময়িক বাহবা কুড়ান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দলের নেতাকর্মীর একটি বড় অংশ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত। তারা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দলীয় কর্মকা-ে অংশ নিতে চান না। বরং সরকারী দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখে চুটিয়ে ব্যবসা করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে চান তারা। বিষয়টি আগে না জানলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভালভাবেই খোঁজখবর নিয়েছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। এ কারণেই তারাও এখন নেতাকর্মীর আচরণে বিব্রত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সামনে একটি লক্ষ্য ছিলÑদল ক্ষমতায় গেলে আবার বিভিন্নভাবে আর্থিক সফলতা অর্জন করতে পারবে তারা। আর এ জন্যই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তারা। রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা আন্দোলনে গা-ছাড়া দিলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী জীবন বাজি রেখে মাঠের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু দলের চেয়ারপার্সন ও মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতারা মাঠে নামতে না পারায় একপর্যায়ে তৃণমূলের নেতারাও হাল ছেড়ে দেন। এ কারণে বিএনপির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় জড়িয়ে বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কয়েক হাজার নেতাকর্মী এখন মামলার খ—গ মাথায় ঘুরছেন। তারা এখন না পারছেন মুক্তভাবে রাজনৈতিক কর্মকা-ে শরিক হতে এবং না পারছেন মামলা থেকে রেহাই পেতে। এ পরিস্থিতিতে তাদের পরিবারেও বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় দলের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মী আন্দোলনে অনীহা প্রকাশ করছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শীঘ্রই নেতিবাচক রায় হতে পারে বলে বিএনপি মনে করছে। তাই এ মামলার রায়কে সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হয় সে বিষয়টিও দলীয় হাইকমা-কে চিন্তায় ফেলেছে। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচীতে ভাটা পড়ার আরেকটি কারণ, এ ব্যাপারে বিদেশীদের নেতিবাচক মনোভাব। জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে বিএনপি যতটা না দলের নেতাকর্মীর ওপর নির্ভর করে তার চেয়েও বেশি বিদেশীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিদেশীদের মতামতের ভিত্তিতেই বিএনপি নাকি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে দলের কোন কোন নেতাকর্মী প্রকাশ্যেই বলে থাকেন। বিদেশীরা নাকি বিএনপিকে আশ্বাস দিয়েছিল, এ নির্বাচন হলেও তা টিকবে না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল বিদেশীরা ঠিকই আওয়ামী লীগ সরকারকে মেনে নিল। এমনকি বিএনপি যাতে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে সে ব্যাপারেও তারা দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি প্রকাশ্যেই বর্তমান সরকারের প্রশংসার পাশাপাশি বিএনপিকে আন্দোলনে না যাওয়ার আহ্বান জানান। আর বিদায়ী মর্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোন দলকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে ভূমিকা পালন করে না। আর ভারতের বর্তমান সরকার তো প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতার কথা বলে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের এ অবস্থানের কারণে বিএনপি হাইকমা- সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে এক পা এগিয়ে আবার তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে কোন কর্মসূচী দেয়া হবে কিনা তা এখনও আমি জানি না। তাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারছি না। তবে যদি কোন কর্মসূটি দেয়া হয় তাহলে আপনারা জানতে পারবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জনকণ্ঠকে বলেন, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন কর্মসূচী প্রণয়নের ব্যাপারে এখনও দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা হয়নি।
×