ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরে নিখোঁজ- ৪৩ বছর পর ফিরে পেল স্বজনরা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

একাত্তরে নিখোঁজ- ৪৩ বছর পর  ফিরে পেল স্বজনরা

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা থেকে নিখোঁজ ৩ সন্তানের জননী রাহেলা খাতুন ওরফে নবীজান (৮০)কে দীর্ঘ ৪৩ বছর পর তাঁর স্বজনেরা খুঁজে পেয়েছেন ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ধলীরকান্দা গ্রামে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ নবীজান স্মৃতির পাতা হাতরিয়ে স্বজনদের নাম পরিচয় জানাতে পারলেও গাইবান্ধা থেকে কিভাবে ময়মনসিংহ এসেছেন জানাতে পারেননি। তারপরও স্বজনদের খুঁজে পেয়ে যারপর নাই খুশি নবীজান। তেমনি মহাখুশি ও আবেগাপ্লুত স্বজনেরাও। স্থানীয় দরদী যুবক জহিরুল হক খানের ৩ মাসের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় হারানো স্বজনদের কাছে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন নবীজান। শনিবার বিকেলে নবীজান কন্যা রাজীয়া বেগম ও ভাতিজা আবুল বাশার ওরফে বাদশাসহ স্বজনদের সঙ্গে ময়মনসিংহ ছেড়ে গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর থানার কৃশামত বাকশির নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। এ সময় ধলীরকান্দা গ্রামের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল। বিদায় জানানোর সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। পারিবারিক সূত্র জানায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হঠাৎ নিখোঁজ হন গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাহপুর থানার কৃশামত বাকশি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী ৩ সন্তানের জননী রাহেলা খাতুন ওরফে নবীজান। এ সময় নবীজানের পুত্র আনিছুর রহমানের বয়স ছিল ১৩ বছর, বড় মেয়ে রাজীয়ার ১২ ও ছোট মেয়ে রাবেয়ার ১১ বছর। বড় মেয়ে রাজীয়া বেগম (৪৫) জানান, এরপর এলাকায় মাইকিংসহ বহু জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তারা নবীজানের কোন সন্ধান পাননি। পাকি সেনারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে অথবা হত্যা করা হয়েছে ভেবে নবীজানের আশা ছেড়ে দেন পরিবার ও স্বজনেরা। এক পর্যায়ে মারা গেছে ভেবে পারিবারিকভাবে ও মসজিদে দোয়া ও মিলাদ পড়ানো হয় বলে জানান নবীজানের ভাতিজা আবুল বাশার ওরফে বাদশা (৪৫)। গত ২০ বছর আগে মারা যান নবীজানের কৃষক স্বামী আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় পরিবারের সদস্যরা মায়ের তীব্র অভাব অনুভব করে। আর কোন দিন ফিরে আসবে না মা-এমন হতাশায় বুকে পাথর চাপা দেন ৩ ভাইবোনসহ স্বজনেরা। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৯৮৮ সালের দিকে হঠাৎ করেই একদিন ‘পাগলি আচরণের’ এক অজ্ঞাত মহিলাকে দেখা যায় ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা সদরের ধলীরকান্দা গ্রামে। কথাবার্তায় অসংলগ্ন দেখে দয়াপরবশ হয়ে ধলীরকান্দা গ্রামের ফার্মাসিস্ট নুরুল ইসলাম তার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার জায়গা করে দিলে মাথা গোঁজার ঠাঁই পান এই হতভাগ্য মহিলা। একাত্তর থেকে ২০১৪ সাল-এ সময়ে কেটে গেছে দীর্ঘ ৪৩ বছর। কোন খোঁজ খবর মিলছিল না। এখানে আসার পর রাহেলার কথায় আঞ্চলিকতার ছাপ বুঝে প্রথমে কুমিল্লার বলে মনে হলেও পরে মহিলার বাড়ি উত্তরাঞ্চলে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। প্রতিবেশী যুবক জহিরুল হক খান গত ৩ মাস আগে আলাপচারিতায় জানতে পারেন মহিলার নাম পরিচয়সহ তার স্বজনদের নাম ও গ্রামের ঠিকানা। জহিরুল মোবাইল ফোনে খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের নানা জায়গার গণমাধ্যম কর্মী ও এনজিও কর্মীদের সহায়তায় মহিলার পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ করার চেষ্টা চালান। অবশেষে রেলস্টেশনের নামের সূত্র ধরে রাহেলার পরিবারের সন্ধান পান জহিরুল। গাইবান্ধার স্থানীয় সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীসহ ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুলকে সহায়তা করায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রাহেলার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর রাহেলার পরিবারকে খবর পাঠালে শুক্রবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধা থেকে ছুটে আসেন বড় মেয়ে রাজীয়া বেগম ও ভাতিজা আবুল বাশারসহ রাহেলা পরিবারের চারসদস্য ও স্বজন। অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট নুরুল ইসলামের পুত্র শহীদুল্লাহ জানান, রাহেলা তাদের ছেড়ে যাওয়ায় কষ্ট হচ্ছে, তারপরও পরিবার ও স্বজনদের ফিরে পেয়েছে এজন্য আনন্দিত তিনি। নাটকীয় এই ঘটনার সন্ধানকারী জহিরুল হক খান জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘ ৪৩ বছর পর একজন মৃত মানুষকে পরিবারের সদস্যরা জীবন্ত খুঁজে পেয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া তার। রাহেলা ধলীরকান্দা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সময় অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান নুরুল ইসলামের বাড়িতে। দীর্ঘদিনের একজন আপনজনকে হারানোর বেদনায় অনেকে ছিলেন বিষণœ ও মর্মাহত। তবে সবার চোখেই ছিল আনন্দাশ্রু। কেঁদেকুটে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিদায় নেন রাহেলাও।
×