ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিবস উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ আর যেন পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান

বিজিবি চার অঞ্চলে কমান্ড বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আধুনিক বাহিনী হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজিবি চার অঞ্চলে কমান্ড বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আধুনিক বাহিনী হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিজিবিকে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) আরও আধুুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই বহু উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হয়েছে, যার সুবিধা পাচ্ছে বাহিনীটি। আরও উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। বিজিবি সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্ত করতে আলাপ আলোচনা চলছে। বিজিবি সদস্যদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সীমান্ত পাহারা দিতে হবে। রোধ করতে হবে চোরাচালান, মাদক, নারী ও শিশু পাচারের মতো অপরাধ। সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের জঘন্যতম পিলখানা হত্যাযজ্ঞের আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকেও প্রতিটি বিজিবি সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে খেয়াল রাখতে হবে। শনিবার সকালে বিজিবি দিবস-২০১৪ এর উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে এ সব কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী পিলখানার বীরউত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ তাঁকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বিজিবির পক্ষ থেকে দেয়া সশস্ত্র সালাম ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। জাতীয় সঙ্গীতের পর প্রধানমন্ত্রী খোলা জিপে চড়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, ২১৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী সীমান্তরক্ষী এ বাহিনী। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর সাহসী ও গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাহিনীটি। একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আজকের বিজিবি (তৎকালীন ইপিআর, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) তাদের বেতারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করায় ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলীকে পাক হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর ১২ হাজার সদস্যের মধ্যে ৮১৭ জন শহীদ হন। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ও শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ ও ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম এবং ৭৭ জন বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন ঐতিহ্যবাহী এ বাহিনী থেকে। এছাড়া ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন শহীদ হন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তিনি বলেন, বিদ্রোহের নামে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ৮৫০ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিদ্রোহের কারণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইনÑ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নতুন এ আইনে ১৯৭২ সালের বিডিআর আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের কারাদ-ের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়েছে। শুধু আইন নয়, কলঙ্কিত অধ্যায়ের কারণে এ বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে বিডিআর থেকে বিজিবি করা হয়েছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে পোশাকেও। ২০০৯ সালের বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের একটি ‘কালো অধ্যায়’ অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের সকল চক্রান্তকারীর অপতৎপরতা আমরা ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছি, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার সম্পন্ন করেছি। আর যেন কোনদিন ২০০৯ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে বিজিবির প্রতিটি সদস্যসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহত বিজিবির একজন নায়েব সুবেদার এবং দুইজন সিপাহির আত্মার মাগফিরাত কামনাও করেন তিনি। নির্বাচনপূর্ববর্তী ও পরবর্তী জামায়াত-শিবিরের হামলায় গুঁড়িয়ে দেয়া বহু উপাসনালয়, মন্দির, বাড়িঘর, দোকানপাট নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তৈরি করে দেয়ায় বিজিবিকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। বিজিবির উন্নয়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিবিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে কমান্ড বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বাহিনীটিকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা হয়েছে। অনুমোদিত ১৫ ব্যাটালিয়নের মধ্যে দশটির কার্যক্রম চলছে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোর কার্যক্রমও শুরু হবে। সীমান্তে টহল জোরদারের সুবিধার্থে সাতক্ষীরার নীলডুমুরে বিজিবির প্রথম ভাসমান বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি) স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া টহল সুবিধার জন্য ১৪শ’ মোটরসাইকেল দেয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ১২৮ বর্ডার সেন্ট্রি পোস্ট। আরও ১২৪টি নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের পার্বত্য অঞ্চলের ৪৭৯ কিলোমিটার অরক্ষিত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি নতুন সেক্টর, পাঁচটি ব্যাটালিয়ন ও ৯২ বিওপি স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রস্তাবিত ৯৩৫ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ২৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে বাহিনীটির গোয়েন্দা বিভাগ বর্ডার সিকিউরিটি ব্যুরোকে। ২০০৯ সালের পর ২০ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ করা হয়েছে বাহিনীটিতে। বিজিবিতে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু রয়েছে। বিজিবি সদস্যদের মূল বেতনের ৩০ ভাগ সীমান্ত ভাতা প্রদান করা হয়েছে। পারিবারিক রেশন ৬০ ভাগ থেকে শতভাগ করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যদের সন্তানরা এখন ২২ বছরের জায়গায় ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত রেশন পাচ্ছে। বিজিবির প্রতিবন্ধী সন্তানদের সম্পূর্ণ চাকরিকালীন রেশন দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন বছরের পর থেকেই বিজিবি সদস্যদের পূর্ণ স্কেলে রেশন দেয়া হচ্ছে। অর্জিত ছুটি এক মাসের পরিবর্তে দুই মাস করা হয়েছে। জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। অর্জিত ছুটি এক মাসের পরিবর্তে দুই মাস করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যদের রেশন ও বাসস্থান সুবিধা বাড়ানো, পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনতে নানা উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। বিজিবি সদস্যদের সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে আটটি স্কুল ও কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদের ঢাকায় বাস করে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি ৮ তলা ছাত্রাবাস এবং একটি ৫ তলা ছাত্রীনিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। বিজিবির হাসপাতালগুলোতে বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি তাদের পিতামাতার চিকিৎসার সুযোগ চালু করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে ৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশের নাগরিকদের আটক করলে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনছে বিজিবি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা কমে এসেছে। পরে প্রধানমন্ত্রী নিজহাতে বীরত্ব ও বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিজিবির ১০ সদস্যকে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদক’, ২০ জনকে ‘প্রেসিডেন্ট বর্ডার গার্ড পদক’ এবং ১০ জনকে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (সেবা)’ ও ২০ জনকে ‘প্রেসিডেন্ট বর্ডার গার্ড (সেবা)’ পদক পরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ মন্ত্রিসভার সদস্য ও উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী পিলখানার বীরউত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনের দরবারে বিজিবি সদস্যদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের মতো বিজিবিকেও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ নিজেদের পছন্দসই বিভিন্ন বাহিনী থেকে লোক নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের তেমন কোন হাত থাকে না। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের তরফ থেকে বিজিবি সদস্যদের জাতিসংঘ শন্তিরক্ষা মিশনে পাঠানোর বিষয়ে কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়নি। তারপরও সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা চলছে। কম্বল বিতরণের নির্দেশ ॥ ষাটোর্ধ দুস্থ মানুষ, এতিম শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দিয়ে শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে কম্বল বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা এরই মধ্যে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন। শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ১৯টি সদস্য ব্যাংক তিন লাখ ৭০ হাজার কম্বল প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করে। এ সময় ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, মহাব্যবস্থাপক ও পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কম্বল অতিদ্রুত শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন বলে জানান আশরাফুল আলম খোকন।
×