ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এম নজরুল ইসলাম

তারেকের আবোলতাবোল

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

তারেকের আবোলতাবোল

ধরাধামে এক নতুন ইতিহাস রচয়িতার আবির্ভাব হয়েছে! তিনি নিজের মতো করে ইতিহাস বলছেন ও প্রচার করছেন। একদা মুচলেকা দিয়ে ‘চিকিৎসার্থে’ বিদেশে যাওয়া এই কাগজে-কলমে অর্বাচীন রাজনীতিক এখন নির্লজ্জ মিথ্যাচারে নেমেছেন। ‘একসেপ্ট বাংলাদেশ’ লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে অবস্থানকারী এই নতুন ইতিহাস রচয়িতা নিজের মতো করে ইতিহাস রচনা করতে শুরু করেছেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে তিনি সেই ইতিহাস প্রচার করছেন। নতুন এই ইতিহাস রচয়িতার নামটি নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর সম্পর্কে সবাই সম্যক জ্ঞাত। মে মাসে বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ব্যর্থ’ রাজনীতিক হিসেবে অভিহিত করে নিজের বাবা জিয়াউর রহমানকে সফল বলে দাবি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এক পর্যায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি এনেছিলেন বলেও দাবি করেন তারেক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ব্যর্থ’ রাজনীতিক আখ্যায়িত করার পর আগস্টে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ‘খুনী পরিবার’, আওয়ামী লীগকে ‘কুলাঙ্গারের দল’ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কুলাঙ্গারদের নেতা’ আখ্যায়িত করেন তারেক রহমান লন্ডনের একটি সভায় তিনি আরও বলেন, ‘এই পরিবারটি শুধু খুনী পরিবার নয়, এই পরিবারটি একটি অভিশপ্ত পরিবার বাংলাদেশের জন্য।’ মরহুম জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কোনদিন নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে জিয়া নিজেই লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।’ এখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনকের স্বীকৃতি দিতে বিএনপির আপত্তি থাকলেও ওই লেখায় জিয়া নিজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কীভাবে বিষোদ্গার করা হত, তাও উঠে এসেছে জিয়ার ওই লেখাটিতে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর জিয়ার আস্থাও ফুটে উঠেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা। বলেছেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বিদ্রোহের পর তিনি নিজেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় জিয়াসহ মুক্তিবাহিনীর তিন ফোর্সের অধিনায়কের স্মৃতিকথা ছেপেছিল। অন্য দু’জন হলেন- খালেদ মোশাররফ ও কেএম সফিউল্লাহ। ‘মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত ত্রয়ী ও তাঁদের স্মৃতিকথা’ শিরোনামের এই অংশে প্রকাশিত তিনটি লেখাই ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক গণবাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে অধুনালুপ্ত বিচিত্রায় উল্লেখ করা হয়। ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামের ওই লেখায় জিয়া লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালী কর্মকর্তারাও তার আঁচ পেতে থাকে। ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলতে থাকে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম’। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করে এই নতুন ইতিহাস কথক নিজের বাবাকেই অস্বীকার করছেন। অবশ্য এটা তাঁর পারিবারিক রীতি। তাঁর মা নিজের জন্মদিন পর্যন্ত পাল্টে ফেলতে দ্বিধা করেননি। জন্মদিন পাল্টে ফেলা মায়ের সন্তান আরও অনেক কিছু পাল্টে নিজের মতো করে নিতে পারেন। অবশ্য বিএনপি অনেকদিন থেকেই দাবি করে আসছে, জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২০১০ সালে ঢাকার একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী কবি বেলাল মোহাম্মদ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান। এরপর করেছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। বিচিত্রার যে সংখ্যায় জিয়ার লেখা ছাপা হয়েছিল, সেই সংখ্যায় ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের লেখায়ও উল্লেখ রয়েছে, মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন শেখ মুজিবের পক্ষে। জিয়ার লেখার শুরুই হয়েছিল এভাবে- ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি. জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে সেদিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ।’ জিয়াউর রহমানের এই লেখাটি জনকণ্ঠেও পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এত কিছুর পরও জানি না কী এক রহস্যজনক কারণে এই নব্য ইতিহাস কথক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একের পর এক কটূক্তি করে চলেছেন? নব্য ইতিহাস কথকের এই স্বলিখিত ইতিহাস কথন নিয়ে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র নেতারাও ইতিহাস বিকৃতিতে বিব্রত হয়েছেন। বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ তারেকের বিষয়টিকে মতিভ্রম হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ তারেক রহমানকে ‘মিসগাইড’ করছে বলেও তারা মনে করছেন। এর ফলাফল বিএনপির বিপক্ষে যাবে বলে বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলকে একটু সাহসী বলতেই হবে। ঢাকার একটি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য, অর্থহীন ও সত্যের অপলাপ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যে যতভাবে দেখার চেষ্টা করুক না কেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।’ এই নতুন ইতিহাস কথক লন্ডনে অনেকটাই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্যে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। তারেক রহমান ইচ্ছা করেই যে এমন কটূক্তি করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লন্ডনে তাঁর কোন রাজনৈতিক কর্মকা- নেই। দেশেও ফিরতে পারছেন না তিনি। মাথার ওপর ঝুলছে মামলার খড়গ। দায়িত্বশীলদের একটি অংশ মনে করছেন, খবরে থাকার জন্যই এ জাতীয় বিতর্কিত মন্তব্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই গর্হিত অপরাধের ক্ষমা নেই। জাতির পিতার অসম্মান ক্ষমা করা যায় না। তারেক রহমান ও তাঁর দলকে এ জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×