ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুবিদ আলী ভূঁইয়া

বিজয়ের আগে শেষ লড়াই

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজয়ের আগে  শেষ লড়াই

(১৬ ডিসেম্বরের পর) গ্লাস, মগ ইত্যাদি পানিপাত্রের অভাবে আমরা পানি পান করি বাঁশের চোঙায় বা শেলের কার্টিজ কেজে। চোখের সামনে তখন শুধু যুদ্ধের ভয়াবহ মূর্তি। দেখতাম বজ্রের মতো আকাশ কাঁপানো শব্দে কামানের গোলা ফেটে পড়ছে। আর শেলের আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের জোয়ানরা মাটিতে শুয়ে পজিশন নিচ্ছে। শত্রুকে লক্ষ্য করে হাতিয়ার তাক করে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে সমানে। ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে তখনও সবাইকে বারুদের মতো জ্বলতে দেখেছি। প্রতিশোধের স্পৃহায় তখন সবাই বদ্ধপরিকর। এদিকে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে আশুগঞ্জ বাজারে আমার কোম্পানির ট্রেঞ্জগুলো ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করার সময় হঠাৎ রেডিওর খবর শুনলাম, নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। আর এই আত্মসমর্পণ মানেই যুদ্ধ শেষ। আমাদের চূড়ান্ত বিজয়। তাই সৈন্যরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল আর উল্লাসে আকাশে এলোপাতাড়ি ফায়ার করতে লাগল। বিশেষ করে আমাদের অটোমেটিক গানের অবিরাম ফায়ারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। তখন আমি পড়লাম সঙ্কটে। কারণ নদীর ওপারেই শত্রু আর ওদের সঙ্গে তখনও আমাদের যুদ্ধ চলছে। যদি তারা নিয়াজীর আত্মসমর্পণ মেনে না নেয়, যদি আবার এ্যাটাক করে বসে, তখন কি হবে? গুলি ফুরিয়ে গেলে কি দিয়ে যুদ্ধ করব। ওদের কী বিশ্বাস, ওরাতো এতকাল পদে পদে বিশ্বাসঘাতকতাই করে এসেছে। তাই অনেকক্ষণ উচ্চস্বরে চিৎকার করে ফায়ার বন্ধ করালাম। অবশ্য ততক্ষণে আমার জোয়ানরা আনন্দ উল্লাসে কয়েক হাজার বাউন্ড গুলি খরচ করে ফেলেছে। ভবিষ্যতে এ কাজ যেন আর না করে তাই সবাইকে ফলিন করিয়ে শাস্তি হিসেবে অস্ত্র মাথায় তুলে একটা পুকুরের মধ্যে মার্চ করালাম। ওরা তাই করল। এই হলো যুদ্ধ এবং যোদ্ধার নিয়ন্ত্রিত জীবন। ভিজে কাপড়েই ওরা রাত কাটাল। তবে ওই কনকনে শীতেও ভেজা কাপড়ে কারো হাসি ম্লান হয়নি, কারণ সবাই তখন সকালের প্রতিক্ষায়Ñ ১৬ ডিসেম্বরের সূর্যোদয়। ১৬ ডিসেম্বর সত্যি সত্যি ঢাকায় পাকবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। তবু দ’দিন পর্যন্ত আশুগঞ্জে ট্রেঞ্জে বসে আমরা ভৈরবে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করলাম। তারপর ওরাও আত্মসমর্পণ করল। শেষ হলো যুদ্ধ। ইতি ঘটল নৃশংসতার। উন্মত্ত দুঃশাসন মুছে নতুন পতাকা নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে দেশ হিসেবে জন্ম নিল এক দেশÑ বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জন করতে তাকে ৩০ লাখ প্রাণ দিতে হলো। পৃথিবীর ইতহাসে আর কোন দেশকে স্বাধীনতার জন্য এত প্রাণ দিতে হয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। তাই আমাদের স্বাধীনতা একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে তেমন বেদনারও। প্রায় শূন্য থেকে শুরু যে সশস্ত্র সংগ্রাম তার সফল সমাপ্তি হলো মাত্র ৯ মাসে, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ৯ মাসের প্রত্যেকটি দিনই ছিল এক একটি ইতিহাসÑ এক একটি বিস্ময়। যে লড়াই চট্টগ্রামের কুমিড়ায় শুরু করেছিলাম তা শেষ করলাম আশুগঞ্জে এসে মার্চ থেকে ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস। কখনও শত্রুর সঙ্গে কখনও প্রকৃতির সঙ্গে। ক্ষুধা, বন্যা, ঝড়, বৃষ্টি, জোঁক, সাপ, অনিশ্চয়তাÑ প্রতি মুহূর্তে একটার মুখ থেকে বেঁচে আর একটার মুখে পড়েছি। শত্রুর ওপর যে মুহূর্তে আঘাত হানব তখনই নামল অঝোর বৃষ্টি, শত্রুকে খতম করে পালাব সামনে পড়ল ভরা নদী, অন্ধকার হারিয়ে দিল পথ। সারাদিন অনাহারে থাকার পর যেই একমুঠো ভাত মুখে তুলেছি অমনি এসে পড়তে শুরু করল শেলÑ এই ছিল সেই পুরো ৯ মাসের প্রতি মুহূর্তের ছবি। কতদিন ভেবেছি আমার বুঝি আর ফেরা হবে না। মুক্ত বাংলাদেশ দেখে যেতে পারব না কোনদিন। যুদ্ধের মাঠে পড়ে থাকবে আমার মৃত দেহ। দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন আমি নেই। তবুও একদিন সেই ভাবনাটুকু মিথ্যে হলো। আমি ফিরলাম। স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরলাম। (সমাপ্ত) লেখক : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি
×