ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকার পতন

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

পাকিস্তানী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকার পতন

বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম এক স্পর্শকাতর ও বেদনাদায়ক অধ্যায়। দেশভাগের এই যন্ত্রণাকাতর স্মৃতি এখন অতীত। তবে ১৯৭১ সালে যাঁরা জীবিত ছিলেন, তাঁদের ১৯৭১ সালের কাহিনী এখনও আবেগাপ্লুত করে তোলে। আসলে তখন কি ঘটেছিল, তার দুটি জোরালো বর্ণনা আছে। কিন্তু ইতিহাস একই থেকে যাবে। সম্ভবত সে জন্যই পাকিস্তানের বিভক্ত হওয়ার বেদনাদায়ক সময়ে যারা জীবিত ছিলেন এমন সাংবাদিকদেরই ‘ওই দুর্ভাগ্যজনক বছরে’ যেসব ভুল করা হয়েছিল তা স্মরণ ও চিন্তা ভাবনা করার সবচেয়ে বেশি সামর্থ্য রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, প্রথম বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলন করা হয় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। ওই সময় ঢাকায় সাংবাদিক ছিলেন আলী আহমেদ খান। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, তখন আমি প্রগতিশীল উর্দু সাপ্তাহিক পাসবানে কাজ করতাম। সাপ্তাহিকটি পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং সামরিক শাসনের অধীনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচার ধারাবাহিকভাবে চালাতে থাকে। যখন তিনি ওই সময়ের ভয়ানক স্মৃতির কথা মনে করতে থাকেন তখন তাঁর চোখ পানিতে ভরে যায়। আলী আহমেদ বলেন, ২৫ মার্চের রাতে আমি আমার বাড়ি থেকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন আমাদের বাড়ি ছিল ঢাকার উর্দুভাষী এলাকায়। ঢাকার বস্তি এলাকা যেখানে বেশিরভাগ শ্রমিক শ্রেণীর বাঙালীরা বসবাস করত, সেখান থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাই আমি। বাতাস ধোঁয়ায় ভরা ছিল আর আকাশ ছিল লাল। আমি মনে করছি এটা ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর চালানো অপারেশন সার্চলাইট। ওই সময় আমাদের পরিবারের কিছু সদস্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে আর কিছু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বাড়ি ছিল দিনাজপুর শহরে। এই অভিযানের পুরো দেশ অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়। শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম এবং অনেক উর্দুভাষী পরিবারও হামলার শিকার হয়। ঢাকায় ঢুকছেন এমন ব্যক্তিদের কাছে আমি শুনেছি, শহরে তারা কিছু ভয়ানক সহিংসতা দেখেছেন। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, আমি ট্রেনে করে দ্রুত আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি যখন আমার বাড়ির বাগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন আমি আমার মা-বাবার শখ করে লাগানো আনারসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাড়ির সবকিছুই ছিল ভাঙা। আমাদের জিনিসপত্র সব জায়গায় ফেলা ছিল। আমার বাবার বই, ভাইয়ের রেকর্ড ও এ্যালবাম। আমাদের বাড়ি লুট করা হয়েছিল। প্রতিবেশীরা আমাকে জানান, আমার বোনের সঙ্গে থাকতে আমার মা পার্বতীপুর গিয়েছেন। আমার বাবা আর ভাই নিখোঁজ ছিল, কিন্তু কেউই তাদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু তারা সবাই মারা গিয়েছিল। আলী আহমদ খান এখন এ্যাবোটাবাদে বসবাস করছেন। ৪৩ বছর আগের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে তিনি হেসে বলেন, এটি অনিবার্য ছিল। আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভের পরও পার্লামেন্টের যখন অধিবেশন না ডাকল, তখন আর কি হতে পারত। তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল। তাঁর মতে, এই রক্তক্ষয়ী বিচ্ছেদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকা-ই দায়ী। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ গবর্নর ছিলেন এ্যাডমিরাল মোহাম্মদ আহসান। যখন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে আসেন, তখন তিনি এ্যাডমিরালকে জিজ্ঞাস করেন, ছয় দফা কি? তখন এ্যাডমিরাল তাকে এটি দেখাতে চাইলে ইয়াহিয়া বলেন, না, না, আমি দেখে নেব। এ থেকেই বোঝা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি তাদের গুরুত্বের অভাব ছিল কতটা। আলী আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং বাঙালীদের অধিকার নিয়ে তার সমর্থনের জন্য তার পরিবারের কিছু সদস্য তাকে একঘরে করেছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে কি ঘটেছিল, তা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু এটি ছিল অনিবার্য। যখন একটি বাহিনী জনগণের মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন এমন প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত। ইসলামাবাদভিত্তিক আরেক সাংবাদিক সিলোসিয়া জাইদি। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ১০ বছর, তখন তাঁরা ঢাকায় থাকতেন। সিলোসিয়া বলেন, আমরা ছোটবেলায় যা দেখেছি, তা আমাদরে মনে ক্ষত রেখেছে, যা কখনও প্রশমন হবে না। আমরা এ নিয়ে কথা বলতে চাই না, কারণ এটি খুবই যন্ত্রণাদায়ক অতীত। কিন্তু যা ঘটেছে কথা না বলে আমরা তা পরিবর্তন করতে পারব না। তিনি বলেন, আমার মনে আছে আমাদের হিন্দু ধোপার একটা সুন্দরী মেয়ে ছিল। একদিন সে আমাদের গেটের বাইরে বসে কাঁদছিল এবং অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। গেটে পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। মেয়েটি কাঁদছে কেন, আমি আমার মাকে জিজ্ঞাস করলে তিনি কোন উত্তর দেননি। আজ আমি বুঝেছি তার এবং তার মতো অসংখ্য মেয়ের কি হয়েছিল। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের কথা স্মরণ করে সিলোসিয়া বলেন, আমি আমাদের ঘরের জানালা দিয়ে দেখি, প্রত্যেকটি জায়গা থেকে মানুষ দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে জনসভায় যোগ দিচ্ছে। আমি দেখি আমাদের বয়স্ক দুধওয়ালা বল্লম হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এরপর শুধু হট্টগোল দেখা যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে নয়, সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। কারণ, বাংলাও তো পাকিস্তান ছিল। এটি মুসলিম লীগের জন্মভূমি। বাঙালীরা গর্বিত জনগণ, তারা তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে গর্বিত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা সবসময় বাঙালীদের নিচু চোখে দেখত এবং তাদের প্রতি খুবই বর্ণবাদী ছিল। এগুলোই ক্ষোভের বীজ বপন করে। তার বাবা ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জাইদি পার্লামেন্টের সদস্য এবং আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। বাঙালী হওয়া সত্ত্বেও তার অখ- পাকিস্তানের সমর্থনের জন্য তিনি মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হন। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আমরা ভাই বা চাচা বলতাম। আমাদের পরিবার ছিল নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের উৎফুল্ল পরিবার। আমার দাদা ও চাচারা আওয়ামী লীগ করত এবং তারা মুক্তির সংগ্রামের অংশ হন। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তার দাদা বুদ্ধিমানের মতো তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। সিলোসিয়া বলেন, শহর থেকে বের হয়েই হাজার হাজার গ্রামবাসীর সঙ্গে নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে আমার। -ডন অনলাইন
×