ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এমন সুখের দিনে কাঁদতে নেই

পোশাকে লাল সবুজ বুকে পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথা

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

পোশাকে লাল সবুজ বুকে পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথা

মোরসালিন মিজান ॥ জীবন কাটে যুদ্ধ করে/ প্রাণের মায়া সাঙ্গ করে...। নয় মাস, দীর্ঘ নয় মাস জীবনের সঙ্গে কোন সংযোগ ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের। শুধু লড়াই করে কেটেছে। যুদ্ধ করতে করতে বাঁচা। যুদ্ধ করতে করতেই মৃত্যু। অস্ত্র নেই। প্রশিক্ষণের অভাব। এরপরও একটি পাকি সৈন্যকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়েননি বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা। বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে তবেই তাঁরা ফিরেছিলেন। মহান বিজয় দিবসে পূর্ব পুরুষের সেই শৌর্য বীর্যের কথা সগৌরবে স্মরণ করল আজকের প্রজন্ম। দিনভর ছিল উৎসব অনুষ্ঠান। প্রতিটি মঞ্চ থেকে গান কবিতা নাটক নৃত্যের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানানো হলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সব মিলিয়ে দারুণ একটি দিন। এদিন যথারীতি পতাকার রঙে সেজেছিল রাজধানীবাসী। সকাল থেকে সন্ধ্যা লাল সবুজের রঙে ভেসেছে। পোশাকে চেতনার রং মেখে ঘুরে বেড়িয়েছে গোটা শহর। বিশেষ করে শাহবাগ, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় ঢল নেমেছিল মানুষের। সকালে বর্ণাঢ্য সূচনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। প্রতিবারের মতোই এখান থেকে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা বের করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এতে জাতীয় পতাকা, ব্যানার ফেস্টুন হাতে অংশ নেন সংস্কৃতিকর্মীরা। যৌক্তিক কারণেই গত কয়েক বছর এই শোভাযাত্রা থেকে প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়েছে। রাজাকারের ক্যারিকেচার ছিল শোভাযাত্রার সর্বাংশে। গো. আযম নিজামীদের ব্যঙ্গচিত্র দেখিয়ে বলা হয়েছে, এদের প্রত্যাখ্যান করুন। বিনাশ কামনা করা হয়েছে অপশক্তির। তবে এবার ব্যতিক্রম। সংস্কৃতিকর্মীরা বাঙালীর সাহস শক্তি ও শৌর্য বীর্যের প্রতীক মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে এনেছেন। বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি থেকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি গড়া হয়েছিল। এভাবে শিল্পীকে স্মরণ করার পাশাপাশি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। ১৬টি ঢাকের বাদন ও নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে যায় শোভাযাত্রা। জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বর্তমান সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফস, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ঝুনা চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেন। শোভাযাত্রা দোয়েল চত্বর, মৎস্য ভবন, শাহবাগ হয়ে টিএসসি এসে শেষ হয়। বিকেলে যথারীতি চলেছে বিজয় উৎসব। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এদিন সঙ্গীত নৃত্য কবিতা ও নাটকের ভাষায় বাঙালীর গৌরবের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিনের তুলনায় অনুষ্ঠানে লোকসমাগমও ছিল বেশি। একই দিন টিএসসি, ধানম-ি রবীন্দ্রসরোবর, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর, ধনিয়াসহ মোট ৯ মঞ্চে চলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানমালা। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ঢল নেমেছিল মানুষের। এদিন পূর্ব পুরুষের গৌরব বুকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজির হয়েছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সকলে মিলে জাতীয়সঙ্গীত গেয়েছেন। টিএসসি এলাকায়ও ছিল হরেক আয়োজন। এখানে সংবাদপত্রে কেমন ছিল একাত্তর, সেটি বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথক আয়োজনে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হওয়া উচিতÑ এ ব্যাপারে মন্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। প্রথম পর্বে আলোচনা করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক মশিউর রহমান ও মোহাম্মদ এ. আরাফাত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আলোচকরা বলেন, পাকিস্তান নামের অবাস্তব ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৃত্ত ভেদ করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্থানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ১৯৭৫-এর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কৃত্রিম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ‘জয়বাংলা’র বিপরীতে ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মভিত্তিক-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুনর্বাসনের মহোৎসব শুরু হয়। এভাবে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি বাঙালীকে বিভক্ত করেছে। বাংলার ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। তারা বলেন, বিজয় দিবসে আমাদের বাঙালী জাতিসত্তার মৌল চেতনায় ফিরে যাবার শপথ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষ, নারী ও আদিবাসীদের যে বিপুল আত্মত্যাগ তা স্মরণে রেখে সকল মানুষের জন্য একটি শোষণহীন-অসাম্প্রদায়িক কল্যাণরাষ্ট্রের বিকাশে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার নতুন প্রজন্মকে দুর্নীতি, বৈষম্য, মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে সদা-সোচ্চার থাকতে হবে। সভাপতির ভাষণে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, শৃঙ্খলিত মানুষকে মহান মুক্তিযুদ্ধ শৃঙ্খলমুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হাজার বছরে এই প্রথম বাঙালী ‘জয় বাংলা’ নামক একটি রণমন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় ফিরে যেতে হবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, স্বর্ণময়ী ম-ল, পল্লব গোমেজ, স্বপ্নীল সজীব ও মোমিন মিয়া। শিল্পকলা একাডেমির বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান থেকে স্মরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মাঠের যোদ্ধাদের সাহস যোগিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের আলোকে জাতীয় নাট্যশালায় মডেল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে একাডেমির সঙ্গে যৌথভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ।
×