ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ॥ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পীদের স্মৃতিচারণ

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধ ॥ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পীদের স্মৃতিচারণ

গৌতম পা-ে ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিকদের অনবদ্য অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের জাদুকরী কণ্ঠে উজ্জীবিত হয়েছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠিত হয়েছিল দেশের মানুষ। এসব শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যারা এখনও জীবিত তাদের অনেকেই অভিমানে নিজেদের আঁড়াল করে রেখেছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন শিল্পী বলেছেন সেই সময়ের কথা। স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনা। সেই সময়ের কয়েকজন শিল্পীর কথোপকথন নিয়ে এ প্রতিবেদন। শিল্পী আবদুল জব্বার : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল একটি সেক্টর। যেখানে শিল্পীরা তাদের কণ্ঠ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। মুক্তি সেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে তাদের উজ্জীবিত করেছিল, সাহস যুগিয়েছিল শরণার্থীদের। আমি তাদেরই একজন। বিজয়ের এত বছর পর আমার একটাই আক্ষেপ, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে দারুণ কষ্টে আছেন। সরকারের উচিত তাদের দিকে একটু সুনজর দেয়। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা চির অটুট থাকুক এটাই আমার একান্ত কাম্য। শিল্পী সুব্রত সেনগুপ্ত : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুধুমাত্র বিজয় দিবস আসলেই শোনা যায়, অন্য সময় তেমন আর শোনা যায় না। আমার ইচ্ছা ছিল সে সময়ের সব গানকে একত্রিত করে সিডি আকারে প্রকাশ করব। দীর্ঘ চার বছর অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে আছি, সে কারণে আর করা হয়নি। আমাকে কেউ দেখতেও আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত ৫২৫টি গান লিখেছি। কিছু কিছু গানের সুরও করেছি। কিন্তু বড় আক্ষেপ এগুলো প্রকাশ করার কোন সুযোগ পাচ্ছি না। গানগুলো যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখাতে পারতাম তাহলে আমি কিছুটা হলেও শান্তি পেতাম। শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল : বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। যদিও সে সময় পাকিস্তানীরা অপপ্রচার করত যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বলে কিছুই নেই। আমরা সেটা ভুল প্রামাণিত করিয়েছিলাম। আমাদের কষ্ট দিয়ে সারাদেশের মানুষের মনোবলকে আমরা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি মনে করি স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও এই শিল্পীরা উপেক্ষিত। তাদের সেভাবে সম্মানিত করা হয়নি। অন্য যে কোন শিল্পীদের থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের সম্মানী বেশি হওয়া উচিৎ। শিল্পী ড. অরূপ রতন চৌধুরী : স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। আমি বলব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটা বিশেষ সেক্টর। এখানের শিল্পীদের এক একটি গান ছিল এক একটি বুলেটের মতো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জাতীয় জাদুঘরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের ছবিসহ জীবনী রাখা হবে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আজও পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে সরকারের কাছে আমার দাবি হলো বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এর থেকে শিক্ষালাভ করে সত্যিকারের দেশ প্রেমিক হওয়ার প্রেরণা পাবে। শিল্পী ফকির আলমগীর : জাতীর পিতার নির্দেশে অপরিসীম ত্যাগ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতার পর আমাদের সে আশা-আকক্সক্ষা ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছিল। গত বছরও বিজয় দিবসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অপশক্তিকে সহিংস দেখেছিলাম, এ বছর আর সে রকম দেখিনি। এরজন্য বর্তমান সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমার এটাই প্রত্যাশা, যে আশা বা উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে একটি স্বাধীন সর্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছিলাম নতুন প্রজন্ম যেন সেটাকে অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করে। শিল্পী তিমির নন্দী : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা নিঃস্বন্দেহে এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী ও কলা-কুশলী মিলে সাড়ে তিনশ’র মতো হবে। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। আমি মনে করি এর থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আর যে বিষয়টা আমাকে বার বার ভাবিয়ে তোলে তা হলো-আমরা যারা স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী তাদের যেন শিল্পী জগৎ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র ডিসেম্বর অথবা মার্চ মাস আসলেই মিডিয়া থেকে আমাদের ডাক পড়ে। কোন একটা জাতীয় অনুষ্ঠান হলেই স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের দিয়ে একটি কোরাস গান করিয়ে দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করা হয়। বছরের অন্য কোন সময়ে আমাদের কোন প্রোগ্রামে ডাকা হয় না। শুধুমাত্র মুখ চেনা কয়েকজন বাদে অন্য শিল্পীরা বঞ্চিত থাকে। শিল্পী তপন মাহমুদ : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রত্যাসা ছিল একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও শান্তিময় রাষ্ট্র। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা এখনও তা পুরোপুরি পাইনি। আমাদের জীবদ্দশায় এ রকম একটি রাষ্ট্র দেখে যেতে পারব কিনা জানি না। তবে আমার বিশ্বাস, একদিন এ ধরনের সুবাতাস আমাদের দেশে আসবে। শিল্পী শাহীন সামাদ : আমি মনে করি সঙ্গীত এমনই একটা মাধ্যম, যার দ্বারা দেশের দুর্যোগপূর্ণ সময়েও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখে। যার নিদর্শন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমরা কণ্ঠ দিনে সেদিন যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম, আজ তার অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হতে চলেছে। যদিও আমাদের সব প্রত্যাশা এখনও পূরণ হয়নি, কিন্তু আমি আশাবাদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একদিন আমাদের এ প্রত্যাশা পূরণ করবে। দেশ একদিন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
×