ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুবিদ আলী ভূঁইয়া

বিজয়ের আগে শেষ লড়াই

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজয়ের আগে শেষ লড়াই

আমাদের বিজয়ের দু’দিন আগের কথা। ১৩ ডিসেম্বর পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর জেনারেল নিয়াজী ইসলামাবাদের কাছে আরও সৈন্য এবং বিমানের সাহায্য চেয়ে পাঠায়। কিন্তু সাহায্য পাঠাবার পথ ছিল না! জল, স্থল ও আকাশপথ সবই বন্ধ। বন্দী অবস্থায়ই তারা যুদ্ধ করছে। এখনও আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের অন্য কোন পথ নেই। ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর বোমারু ও জঙ্গী বিমান ঢাকা শহরে অবিরাম আক্রমণ চালায়। ঢাকা সেনানিবাস চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে সেই তীব্র আক্রমণে। ঢাকা গবর্নর হাউসে দালাল গবর্নর আবদুল মালিক যখন তার মন্ত্রিসভা নিয়ে শলাপরামর্শে ব্যস্ত সেই সময় তাদের আশপাশেই পড়ে ভারত-বাংলাদেশ বিমানের বোমা। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন গবর্নর। প্রাণভয়ে সে তার মন্ত্রীদের নিয়ে নিরপেক্ষ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে অবস্থান নেয়। নিয়াজী আশা করল সম্ভবত তাদেরই সাহায্যে এসেছে মার্কিন বন্ধুরা। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হলো না। ওই দিনই নিয়াজী বুঝতে পারে তার আশা পূর্ণ হওয়ার নয়। এ ছিল বিজয়ের তিনদিন আগের ঢাকা ও চট্টগ্রামের চিত্র। এদিকে আমরা (একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ১২ ডিসেম্বর আজবপুর, পানিশ্চর, সোহাগপুর এবং তালশহরের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন সময়ে শত্রুর পাল্টা আক্রমণ মোকাবেলায় পজিশন নিয়ে চলেছি। এসব গ্রাম ছিল শত্রুর লক্ষ্যবস্তু। শত্রুর অজস্র আর্টিলারি শেলিংয়ের মধ্যে আমাদের কোম্পানিকে এসব গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়। ১২ তারিখ রাত ১১টায় আমাদের কোম্পানি মিত্রবাহিনীর ১০নং বিহার রেজিমেন্টের বি-কোম্পানিকে পুনর্সংস্থাপন করি। ঢাকায় যখন যুদ্ধের তীব্রতা গতি পাচ্ছিল তখন আমরা যুদ্ধ করছিলাম ভৈরব নদীর পূর্ব পারে, আশুগঞ্জে। ওই সময় আমরা একেবারে শত্রুর মুখোমুখি। অবস্থা এমন ছিল যে, আমরা পরস্পরকে চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছিলাম। অকারণেই তারা ভারি কামানের সাহায্যে আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে চলে। আমাদের এখানে পাকবাহিনী প্রবল বাধার সৃষ্টি করে, তাই আমরা এগিয়ে আসতে পারছিলাম না। ১২ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত এই ৫ দিন আমাদের কোম্পানির সবাইকে আর্টিলারি শেল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রেঞ্জের ভেতর কাটাতে হয় এবং আমাদের সবাইকে একরকম না খেয়েই যুদ্ধ করতে হয়। এদিকে নিয়াজী দেখল আমেরিকা বা চীন কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসছে না তখন নির্বোধের মতো চালিয়ে যাওয়া অনর্থক মনে করে শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। দিল্লী জানালো কোন শর্ত নয়Ñ পুরোপুরি আত্মসমর্পণ চাই। এই প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য ১৬ তারিখ সকাল পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। ১৫ ডিসেম্বর বলা হলো এই সময় পর্যন্ত বিমান আক্রমণ বন্ধ থাকবে। আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ তারিখে ৯টার পরে আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়া হবে। নিয়াজী মুশকিলে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে আত্মসমর্পণ ছাড়া বাঁচারও পথ নেই। ওদিকে পাকিস্তানপন্থী বড় ব্যবসায়ীরা তাকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দেয়। চাপ দেয় বিদেশী দূতাবাস, কূটনীতিক এবং সাংবাদিকরা। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজী আত্মসমর্পণ করবে বলে রাজি হয়। মাথা হেট করল পাকিস্তানী বাহিনীর প্রবল প্রতাপশালী শার্দূল জেনারেল টাইগার নিয়াজী। আমাদের অকুতোভয় বীর যুবকরা ভারত থেকে অভিযান শুরু করার সময় কেউই পরনের কাপড়, হাতিয়ার এবং গোলাবারুদ ছাড়া অন্য কিছু সঙ্গে আনেনি। ওই ডিসেম্বরের রাতের কনকনে সেই ঠা-ায় তাদের পরনের একখ- কাপড়ই ছিল শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্বল। স্বাধীনতা লাভের প্রবল স্পৃহায় ও আত্মত্যাগের জ্বলন্ত মহিমায় তাদের মনোবল তখন আকাশচুম্বি। তাই সেদিন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শারীরিক কষ্ট কিছুই তাদের নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এদিকে আশুগঞ্জ তখনও পাকবাহিনী আমাদের অবস্থানের ওপর কামান আর মেশিনগান দিয়ে ঘন ঘন আঘাত হেনে চলছে, তাই জনসাধারণ আমাদের কাছে আসতে পারেনি, আমাদের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণার অন্ন-জল যোগাতে পারেনি। নানা অসুবিধার ভেতরে কোন রকমে ছেলেরা দুটি চাল ফুটিয়ে নিয়ে খায়। (চলবে)
×