ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

সবকিছুই জীবন্ত হয়ে ধিক্কার দিচ্ছে খান সেনাদের

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

সবকিছুই জীবন্ত হয়ে ধিক্কার দিচ্ছে খান সেনাদের

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘বাংলাদেশের বীর পুলিশ ভাইসব- সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সন্তান। আমরা বাঙালী। আমরা বাংলাদেশের পুলিশ। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। জয় বাংলা- আবদুল খালেক’। ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এ ১৯৭১ সালে সারাদেশের পুলিশ সদস্যদের প্রতি পুলিশ প্রধান আবদুল খালেকের হাতে লেখা তিন পাতার এই চিঠিটি এখনও অক্ষত। জাদুঘরে আছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি বন্দুক, বেতার যন্ত্র, পাগলা ঘণ্টাসহ বিশাল সংগ্রহশালা। আছে পুলিশ সদস্যদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস ও পোশাক। আছে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের সময় ব্যবহার করা সার্চ লাইটসহ অস্ত্র। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র, সংবাদচিত্রসহ নানা ইতিহাস। সবকিছুই যেন জীবন্ত হয়ে এখনও পাকিস্তানীদের বর্বরতার প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে। ছবিতে থাকা শহীদরা যেন বারবার দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে চলেছেন, ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে রাজারবাগের পুলিশ লাইন্সে ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বর্বর পাকিস্তানী সেনারা। মেতে ওঠেছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞে। সেদিন নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় ১৭৪ জনের বেশি পুলিশ সদস্যকে রাজারবাগে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ১৪ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য। অথচ প্রচারের অভাবে রাজারবাগের ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এর খবর তেমন কেউ রাখেন না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জাদুঘরের বাইরে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের শ্বেতপাথরে লেখা শহীদদের নাম মুছে যেতে বসেছে। ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না...’॥ ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলবো না/ আমরা তোমাদের ভুলবো না...’। সত্যিই দেশ রক্ষার প্রয়োজনে মুক্তিকামী জনতার সেদিনের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস ভুলবার নয়। এখনও যেন সবকিছু জীবন্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুলিশে দায়িত্বরত অবস্থায় দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সেদিন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছিলেন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এর সবকিছুই ঠাঁই পেয়েছে পুলিশের এই জাদুঘরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বরিশালে দায়িত্বরত পুলিশ সুপার গোলাম হোসেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ২৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। জাদুঘরের দেয়ালে বীর এই মুক্তিযোদ্ধার ছবিসহ ইতিহাস এখনও জ্বলজ্বল করছে। এএসডিও হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় যুদ্ধে যোগ দেন পিরোজপুরের মহকুমায় ফয়জুর আহমেদ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে ৫ মে হত্যা করে। নড়াইলে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম রব্বানী। ২১ এপ্রিল তাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বন্দী করে। পরে যশোর সেনানিবাসে তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর ছবিসহ ইতিহাস লেখা রয়েছে জাদুঘরে। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন আঃ কাদের মিয়া। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ লাল সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এক জুন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়াও জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশে কর্মরত এসপি মুন্সি কবীর উদ্দিন, আল মামুন, এসপি শাহ আবদুল মজিদসহ অনেকের ইতিহাস ও ছবি। ‘সার্চ লাইট’ ॥ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময়জুড়ে চলে যুদ্ধ। সেদিনের রণাঙ্গন থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যবহার করা অনেক কিছুই স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে। এগুলোর মধ্যে সার্চ লাইট অন্যতম। দূর থেকে শত্রুর উপস্থিতি ও অবস্থান দেখার জন্য এ লাইট ব্যবহার করত পাকিস্তানী সেনারা, যা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেও ব্যবহার করা হয়েছে। বিশাল আকৃতির এই লাইটি জাদুঘরের প্রদর্শনীতে রয়েছে। এছাড়ার পাকিস্তানী বাহিনীর মর্টারশেল। রায়ট রাবার শেলও রয়েছে। আলাদা ধরনের বন্দুক দিয়ে ৯০ ডিগ্রী কোণে উত্তেজিত জনতার প্রতি রায়ট শেল নিক্ষেপ করা হতো। জাদুঘরজুড়ে শহীদের স্মৃতি চিহ্ন ॥ জাদুঘরজুড়েই শহীদদের স্মৃতি চিহ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহারিক জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে আলোকচিত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রের কাটিং। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া নেতাদের ছবি ও পুলিশের দালিলিক বিভিন্ন চিঠিপত্র। ২৫ মার্চ রাতে যে বেতার যন্ত্রটি ব্যবহার করে সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেয়া হয়েছিল তা যতœ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশের হাতে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সাধারণ ছিল থ্রি-নট থ্রি রাইফেল। তাতে কি। কেউ ভীত ছিলেন না। সামান্য অস্ত্র নিয়েই দেশমাতৃকা রক্ষায় প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সবাই। সেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল জাদুঘরের সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে এই রাইফেলে ব্যবহৃত গুলির খোসাও। আছে পুলিশের ব্যবহৃত হ্যান্ড মাইক। পুলিশ সদস্য শহীদ আবদুস সামাদ ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শ্বেতপাথরে খোদাই করা ফলক। নড়াইলে শহীদ ইন্সপেক্টর গোলাম রব্বানীর পুলিশের পোশাক রয়েছে এই জাদুঘরে। আছে কনস্টেবল মোঃ আবু সামাদের হেলমেট। স্বাধীন বাংলার প্রথম পুলিশ প্রধান ছিলেন আব্দুল খালেক। তিনি যে চেয়ারে বসে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের কর্মকা- পরিচালনা করতেই সেই চেয়ারটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে। আছে তাঁর ব্যবহার করা তলোয়ার। আছে শহীদ পুলিশ সদস্য কাদের মিয়ার কলম, রেঙ্কবেচ, রেল্ট, কলম। অজ্ঞাত এক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধার হেলম্যাট সংগ্রহ করা হয়েছে জাদুঘরে। যুদ্ধের সময় এই হেলমেটটি ব্যবহার করা হয়েছিল। আছে ফয়জুর রহমানের হাতে লেখা ডায়েরি ॥ নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে পুলিশ বাহিনীতে কর্তরত ছিলেন। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তাকে হত্যা করে পাকিস্তানী নরপিশাচরা। পরে তাঁর লাশ শনাক্ত করা হয়। জাদুঘরে তাঁর ব্যবহার করা হাতে লেখা ডায়েরি ও টেপ রেকর্ডার সংরক্ষণ করা হয়েছে। কালের সাক্ষী ‘পাগলা ঘণ্টা’ ॥ ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণের মুহূর্তে তৎকালীন পুলিশ প্রধানের বডিগার্ড কনস্টেবল ‘আবদুল আলী’ লোহার পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে বিভিন্ন স্থান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের এক করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল সেদিন। লোহার সেই পাগলা ঘণ্টা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা রয়েছে। আছে চাকাওয়ালা মেশিনগানও। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আক্রমণের পর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের প্রশাসনিক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে দলিল সস্তাবেজ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে আর সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের’ ॥ ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের পুলিশ প্রধান ছিলেন আবদুল খালেক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সব পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে তিন পাতার চিঠি লিখেছিলেন, যা প্রতিটি ব্যারাকে পাঠানো হয়েছিল। এই চিঠির পর সারাদেশের পুলিশ সদস্যরা দেশপ্রেমে আরও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সকলে মিলে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিরোধ গড়ে তুলেন পাক হানাদারসহ দেশীর দোসরদের বিরুদ্ধে। চিঠির শুরুটা ছিল ঠিক এ রকম- ‘বাংলাদেশের বীর পুলিশ ভাইসব- সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সন্তান। আমরা বাঙালী। আমরা বাংলাদেশের পুলিশ। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। জয় বাংলা- আবদুল খালেক’। সাবেক পুলিশ প্রধানের হাতে লেখা তিন পাতার চিঠিটি জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এদিকে আইজিপি আবদুল খালেক রেডিওতে দেয়া ভাষণেও পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। একজন বীর সার্জেন্ট মোঃ মর্তুজার কথা ॥ ১৯৬০ সালের ৬ আগস্ট ঢাকা জেলায় পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজারবাগে আক্রমণ করলে তিনি প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র তুলে নেন। এর আগে তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারের ইনচার্জ সুবেদার আবুল হাশেম ও সুবেদার গোলাম মোস্তফাসহ অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে পুলিশ সদস্যদের মাঝে অস্ত্র বিতরণ করেন। রাজারবাগে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ৬ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পরেন, পরে মুক্তি পান তিনি। রাজারবাগ আক্রমণের ইতিহাস ॥ ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী অতর্কিতভাবে রাজারবাগ আক্রমণ করে। পুলিশ লাইন্স হাসপাতালের দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনী প্রথম গোলাবর্ষণ শুরু করে। এ সময় পুলিশ লাইনে উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা ছিলেন না। সাধারণ পুলিশ সদস্যরা নিজেদের সিদ্ধান্তে সেদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তারা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধের যুদ্ধের সূচনা করেন। তখন থ্রি নট থ্রি (৩০৩) বন্দুকই ছিল একমাত্র ভরসা। যুদ্ধের একপর্যায়ে শেষ রাতের দিকে গোলা ফুরিয়ে এলে পাকবাহিনী রাজারবাগ দখল করে নেয়। তখন ঘাতক বাহিনী ব্যাপক লুটপাট চালায়। তারা আটকেপড়া পুলিশদের নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। সুইপার রাবেয়াসহ অন্য নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ শুরু করে। তারা একযোগে পিলখানার ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ও ইকবাল হলে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তৎকালীন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার খবর মতে, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পর পাক বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দিকে অগ্রসর হয়। প্রথমে পাক বাহিনীর ট্যাংক থেকে গোলা ছোড়ে। পরে কোয়ার্টারে ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যদের ওপর পাশবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেই রাতে শহীদ হওয়া পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা জানা না গেলেও খুব বেশি পুলিশ সদস্য পালিয়ে যেতে পারেননি। সেই যুদ্ধে ২০৪ জন পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে ৩০ জনকে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় বাকিরা সবাই শহীদ হয়েছেন। আক্রমণের খবর ছড়িয়েছিলেন কনস্টেবল শাজাহান মিয়া ॥ ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিলেন কনস্টেবল শাজাহান মিয়া। ওয়ারলেস বেইজ স্টেশনের অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। রাজারবাগ আক্রমণ হওয়ার খবর তিনি প্রথম বেতার মাধ্যমে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেন। সেই রাতে তিনি হেডকোয়ার্টার্স বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে যুদ্ধ করেন। ভোর রাতের দিকে তার গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানী বাহিনী রাজারবাগে প্রবেশ করে চারদিক ঘিরে ফেলে। সকালে তিনি পাক বাহিনীর হাতে আহত হন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। ২৮ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি মেলে তার। এরপর সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। বীর এই মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন। সবার জন্য উন্মুক্ত পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ॥ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ডিআইজি হাইওয়ে অফিস ভবনের একপাশে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। দর্শনার্থী সবার জন্য জাদুঘর উন্মুক্ত। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি। শুক্রবার বিকেল ৩-৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। এন্ট্রি ফি ৫ টাকা। তবে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ জন দর্শনার্থী আসেন এখানে। তবে বিশেষ দিনে অর্থাৎ বিজয় দিবসসহ অন্যান্য দিবসে দর্শনার্থী তুলনামূলক বেশি হয়। জাদুঘরে কর্তব্যরত কনস্টেবল লাইজু জানান, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চারজন পুলিশ কনস্টেবল জাদুঘরের দায়িত্ব রয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা। অপর কনস্টেবল শহিদুল জানান, প্রচারের অভাবে দর্শনার্থী কম হয়। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জাদুঘরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের লালবাগ জোনের এডিসি আবিদা সুলতানাকে জাদুঘরের সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অবহেলায় স্মৃতিস্তম্ভ ॥ জাদুঘরের ঠিক সমানে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ বীর পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলার শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভজুড়ে। শ্বেতপাথরে খোদাই করা বীর সন্তানদের অনেকেরই নাম এখন মুছে গেছে। কাছে গিয়েও দেখার উপায় নেই। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেই এমন বেহাল দশা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনেও শহীদদের বিষয়টি নজরে আসেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
×