ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে বেতারের ভূমিকা অপরিসীম

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে বেতারের ভূমিকা অপরিসীম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানী শাসনামল ও স্বাধীন বাংলাদেশ- এই তিন কালের সাক্ষী বাংলাদেশ বেতার। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে আছে গণমানুষের সবচেয়ে কাছের এই সম্প্রচার মাধ্যমের ইতিহাস। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রটি পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ বেতারে। অন্যদিকে ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পুরানা ঢাকার খাজা নাজিমউদ্দীন রোডে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে সূচনা হয় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। আর জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালীর আত্মপ্রকাশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছে এই সম্প্রচার মাধ্যমটি। বিশেষ করে একাত্তরে বেতারের শব্দ তরঙ্গে উজ্জীবিত হয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মুক্তিকামী জনতা। সংগ্রামমুখর নয় মাস মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবল দৃঢ় রাখতে অসীম ভূমিকা রেখেছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ গণমাধ্যমটি। সময়ের বহমানতায় বাংলাদেশ বেতার অতিক্রম করেছে প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর। সেই সূত্রে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শুরু হলো হীরকজয়ন্তী উদ্্যাপনের চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। সোমবার বিকেলে আগারগাঁওয়ের জাতীয় বেতার ভবনে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশ বেতারের অপরিসীম ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এর আগে সকালে শাহবাগের বেতারের সদর দফতর থেকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে বের হওয়া আনন্দ-উচ্ছ্বাস মাখা শোভাযাত্রার মাধ্যমে চারদিনের কর্মসূচীর সূচনা হয়। শোভাযাত্রা শেষ হলে চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও নিয়মিত বেতার শুনতেন। বেতারের মাধ্যমেই তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সত্তরের নির্বাচনের ফল শুনেছিলেন। আমার নিজেরও দীর্ঘদিনের অভ্যাস বেতার শোনা। একাত্তরের বেতারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এর প্রতিবাদে বেতারের দেশপ্রেমিক-সাহসী কর্মীবাহিনী সেদিন সকল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে দেন। সেই চাপে পরদিন আটই মার্চ ইয়াহিয়া সরকার সেই ভাষণ সম্প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর পঁচিশে মার্চ কালরাতে যখন পাকিস্তানী হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দেয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে বিবেচিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা অর্জনে বেতারের ভূমিকা অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বেতারের কর্মচারীদের পেনশনের আওতাভুক্ত করার ঘোষণা দেন। এছাড়া বর্তমানে শিল্পীদের প্রদত্ত সম্মানীকে লজ্জাজনক উল্লেখ করে তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া বেতারের কর্মচারীদের স্বার্থে সম্প্রচার ক্যাডার নামে একটি বিশেষ ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। একাত্তরের বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিকে উজ্জীবিত করা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার দেশাত্মবোধক গান, রম্যনাট্য জল্লাদের দরবার, রম্যকথন চরমপত্রসহ অসংখ্য অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছিল। বেতার নিয়ে রাজনীতিকরণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের আদলে রেডিও বাংলাদেশ নাম দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের গান করা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন বেতারে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া নিষিদ্ধ ছিল। আপামর জনগোষ্ঠীর কাছে বেতারের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আবহমান বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ বেতার। বেতারের অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনমানুষের তথ্য, শিক্ষা ও বিনোদনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎসব। ঝড়-ঝঞ্ঝা কিংবা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বেতারের নিরলস কর্মীবাহিনী জরুরী তথ্য প্রদান করে সব সময়ই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এছাড়া টেলিভিশনের তুলনায় বেতারে অনেক বিস্তারিত সংবাদ পাওয়া যায়। আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায় বেতারের কার্যক্রম। যা অন্য মাধ্যমে সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার সঙ্গীতশিল্পী, ৩ হাজার নাট্যশিল্পী, ৮০০ উপস্থাপক-উপস্থাপিকা, ৪ হাজার শিশু-কিশোর ও আটশ’ কলাকুশলীর প্রতিভা বিকাশের সর্ববৃহৎ গণমাধ্যম বাংলাদেশ বেতার। এই প্রতিষ্ঠান অসংখ্য গুণী, দরিদ্র, অবহেলিত, বয়োবৃদ্ধ শিল্পীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম অর্থের যোগান দিচ্ছে। নিজের বেতার প্রীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমরা যখন বন্দী হই তখন সঙ্গী ছিল শুধুমাত্র একটি রেডিও। বন্দীশালায় বসে বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতার খবর শুনতাম। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নিজের জীবনবাজি রেখে বাংলাদেশ বেতার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছেন এমন ১০ জনকে সম্মাননা প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু নিজেই এ সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পঁচাত্তরে ঘাতকের হাতে তিনি নিহত হওয়ার পর সেটা আর সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে আমি উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এ বছর এ সম্মাননা প্রদান করতে পেরে আমি প্রশান্তি বোধ করছি। সম্মাননাপ্রাপ্ত দশজন হলেনÑ বেতারের কর্মকর্তা মরহুম বেলাল মোহাম্মদ, প্রকৌশলী আবদুস শাকের, প্রধান প্রকৌশলী মরহুম আমিনুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী রাশিদুল হোসেন, মরহুম মোস্তফা আনোয়ার খান, সাবেক প্রকৌশলী এ এম শফিউজ্জামান, মরহুম আবদুল্লাহ আল ফারুক, রেজাউল করিম চৌধুরী, মরহুম কাজী হাবিব উদ্দীন আহমেদও মরহুম আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। জাতীয় বেতার ভবনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বর্ণিল বেলুন উড়িয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি আলোচনা পর্বের শুরুতে বাংলাদেশ বেতারের হীরকজয়ন্তীর স্মারক ডাকটিকেট ও খাম অবমুক্ত করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রী তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেতারের মহাপরিচালক কাজী আখতার উদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ। চার দিনের বর্ণিল অনুষ্ঠানসূচী ॥ সোমবার বিকেলে প্রথম পর্বের আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় শুরু হয় খ্যাতিমান শিল্পীদের অংশগ্রহণে নানা পরিবেশনায় সাজানো মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমেই প্রদর্শিত প্রামাণ্য ভিডিও প্রদর্শনী। এরপর মঞ্চে আলো ছড়ায় নৃত্যের ঝংকার। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যশিল্পী লিখন ও নাদিয়া জুটি । ‘শোনো একটি মজিবরের থেকে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ, শামীম আরা নীপা ও তাঁদের দল। অনুষ্ঠানে নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইয়াসমীন মুসতারী। সাবিনা ইয়াসমিনের সুরে সুরে সাজানো ছিল বিশেষ একটি পর্ব। এ পর্বে খ্যাতিমান শিল্পী উন্মুক্ত আয়োজনে শ্রোতাদের নিজের জনপ্রিয় গান শোনান। পরিবেশিত হয় সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত অর্কেস্ট্রা। আজাদ মিন্টুর পরিচালনায় শিল্পীরা সুরের আশ্রয়ে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কে তুলে ধরেন। আজ মঙ্গলবার বিজয় দিবসে বেলায় আড়াইটা থেকে শুরু হবে অনুষ্ঠানমালা। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনগীতি থেকে শুরু করে থাকবে পট গান, টমটমের গান, গম্ভীরা, পুঁথিপাঠ, সিলেটের লোককবিদের গান, ভাওয়াইয়া, বিয়ের গীত, ধামের গানসহ বহুবিধ আয়োজন। শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন গাজী আবদুল হাকিম ও ফিরোজ খান। নৃত্যায়োজনে থাকবে চাকমা জুম নাচ, ত্রিপুরা বোতল নাচ ও লুসাই ব্যাম্বু নাচের মতো আকর্ষণীয় পরিবেশনা। এছাড়াও থাকবে কবিতা আবৃত্তি। তৃতীয় দিন বুধবারে অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে। এদিন সকালে আলোচনা শেষে বিকেল ৩টায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গানগুলো গাইবেন শিল্পীরা। পরিবেশিত হবে ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকের অংশ বিশেষ। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকবে এম আর আক্তার মুকুলের ঐতিহাসিক ‘চরমপত্র’ থেকে পাঠ। এছাড়াও জারী গান, বাংলা কাওয়ালী, ইত্যাদি আয়োজন থাকবে। সমাপনী দিনে ১৮ ডিসেম্বর সকাল থেকেই থাকবে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। এদিন প্রথম পর্বে থাকবে মানিক চাঁদের কেচ্চা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জারী গানসহ নানা আয়োজন। আয়োজকরা জানান, বিকেলে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আলোচনা ও স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে চার দিনব্যাপী আয়োজন।
×