ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাবনায় প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ॥ ৫০ হাজার লিটার নকল দুধ-ঘি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

পাবনায়  প্রতিদিন  তৈরি হচ্ছে ॥ ৫০ হাজার লিটার নকল দুধ-ঘি

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে আবারও তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নকল ও ভেজাল দুধ-ঘি। আর এ নকল ও ভেজাল দুধ-ঘি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ছানার পানি, স্কিমমিল্ক পাউডার, দুধের ননী, সয়াবিন, আলুর পেস্ট, হাইড্রোজ, লবণ, চিনি, ফরমালিন ও কালার ফ্লেভার। তাজা রাখার জন্য ছানায় দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। জানা যায়, স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদী পাড়ে স্থাপন করা হয় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা। এর আওতায় ৩৫০টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি রয়েছে। সমিতিতে গো-খামার রয়েছে ১২ সহস্রাধিক। এসব সমিতি প্রতিদিন গড়ে আড়াই লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া দুটি জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গাভী পালন করা হয়। এসব গাভী থেকে আরও এক লাখ থেকে সোয়া লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। এই দুধ মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও ঘোষেরা ক্রয় করে থাকেন। এই দুগ্ধ অঞ্চলকে টার্গেট করে প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্রাক ফুড (আড়ং), আমো ফ্রেস মিল্ক, কোয়ালিটি, বিক্রমপুরসহ বেশকিছু বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে এ অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে। এর ফলে তরল দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার তাদের জীবিকার পথ খুঁজতে গাভী পালন ও দুধের ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গো-খামার। এদিকে চাহিদার তুলনায় দুধ উৎপাদন কম হওয়ায় ছানা উৎপাদক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা গোপনে নকল দুধ তৈরি করে আসল দুধের সঙ্গে মিশিয়ে বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি করছে। এতে আসল দুধও ভেজাল দুধে পরিণত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রতিদিন সাড়ে চার লাখ লিটার দুধের চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ লিটার। এর মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার লিটার থেকে দেড় লাখ লিটার বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা, পৌনে দুই লাখ লিটার দুধ আফতাব, আকিজ, প্রাণ, আমোফ্রেস মিল্ক, ব্রাকসহ বিভিন্ন বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান, গোয়ালারা ৫০ থেকে ৫৫ হাজার লিটার, দুই শতাধিক মিষ্টির দোকান ১৫ হাজার লিটার, হাট-বাজারে স্থানীয় ক্রেতারা প্রায় ১০ হাজার লিটার দুধ ক্রয় করে থাকেন। এ হিসাবে প্রতিদিন দুধের ঘাটতি পড়ে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার লিটার। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করে দুধের এই ঘাটতি পূরণ করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার গোয়ালা ও ব্যবসায়ীরা শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মণ) ছানা তৈরি করে। ওই পরিমাণ ছানা তৈরিতে প্রায় এক হাজার চারশ’ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। গোয়ালা ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করে রাখেন। পরে ওই ছানার পানির সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় নকল দুধ। প্রতিটি কারখানায় সব সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার লিটার ছানার পানি মজুদ রাখা হয়। জেলা দুটির আব্দুর রশিদ, নাজমুল, আব্দুল কদ্দুস, সরোজিদ কুমার ঘোষ, দুলাল চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বনাথ গোষ, পরিমল ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, দুলাল ঘোষ, রবি ঘোষ, মানিক লাল ঘোষ, নবরতœ ঘোষ, মেজর ঘোষ, নব কুমার ঘোষ, রঞ্জিত কুমার ঘোষ, অধির কুমার ঘোষ, রঘু ঘোষ, প্রেম কুমার ঘোষ, মিঠু ঘোষ, বাচ্চু ঘোষ, জিকরুল, উত্তম, নরেন হলদার, প্রশান্ত, রঞ্জন, সাধন ঘোষ, অখিল, এমদাদুল, ইসলাম, আমিরুল, পরিতোষ ঘোষসহ শতাধিক ঘোষ ও ব্যবসায়ী ভেজাল ও নকল দুধ-ঘি তৈরির সঙ্গে জড়িত বলে সূত্র জানিয়েছে। বেড়ার প্রাণ ডেয়ারির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক শরিফ উদ্দিন তরফদার জানান, কারখানার দুধ শুধু আমরাই নয়, আড়ং, আকিজ, আমোমিল্ক, আফতাব, মিল্কভিটাসহ অন্যান্য কোম্পানি সংগ্রহ করে থাকে। তবে তাদের দুধ সংগ্রহ পদ্ধতি শতভাগ ভেজালমুক্ত বলে তিনি দাবি করেন। আড়ংয়ের (ব্রাক) আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আলতাব হোসেন জানান, তারা সরাসরি গো-খামারিদের কাছ থেকে কোম্পানির নিজস্ব কর্মচারী দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে ভেজালমুক্ত দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপরও দুধ সংগ্রহ নিয়ে সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ কোম্পানির গাজীপুর প্রধান কারখানায় পরীক্ষায় ভেজাল দুধ ধরা পড়লে সেই সংগ্রহ কেন্দ্রের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণাত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. তাহমিনা এইচ খাঁন জানান, খাঁটি ঘিয়ের গলনাংক হবে ২৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এর কম তাপমাত্রাতেও এটি দানাদার হয়ে জমাট না বাঁধলে বুঝতে হবে এতে ভেজাল রয়েছে। ২৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের বেশি এবং ৩০ ডিগ্রীর কম তাপমাত্রায় খাঁটি ঘি জমবে না। আসল ঘিয়ে পানি থাকবে শূন্য দশমিক ১ ভাগ। ভোজ্য তেলের গন্ধ হয় ভোঁতা এবং ঘিয়ের গন্ধ হবে চমৎকার। মানুষের জীবন রক্ষার্থে বাজারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি নিয়মিত পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইকে তৎপর হতে হবে বলে তিনি জানান। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ শামীম হোসাইন জানান, দীর্ঘদিন ধরে কেমিক্যালমিশ্রিত দুধ পান করলে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ফরমালিন মেশানোর ফলে হেপাটোটক্সিকিটি বা লিভার রোগ, কিডনি রোগ, ক্ষতিকর মিল্ক পাউডারের ফলে মানবদেহে হাড়ের মধ্যকার দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভব, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আর ভেজাল ঘি খাওয়া মানে বিষ খাওয়া। এতে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্ট এ্যাটাক, চোখের অসুখ বেড়ে যাবে।
×