ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ কসাই সিরাজের নির্দেশে আমার মামাসহ ৪২ জনকে গুলিতে হত্যা

সপ্তম সাক্ষী নিমাই দাশের জবানবন্দী

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

সপ্তম সাক্ষী নিমাই দাশের জবানবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের কসাই সিরাজ মাস্টারসহ তিন জনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সপ্তম সাক্ষী নিমাই চন্দ্র দাশ জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবাবন্দীতে তিনি বলেছেন, সিরাজ মাস্টার বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় তাদের গুলিতে আমার বড় মামা নকুল দাশসহ ৪২ জন নিহত হয়। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী আবুল হাসান সাক্ষীকে সংক্ষিপ্ত জেরা করেন। আজ আবার পুনরায় জেরা করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রবিবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সাক্ষীকে জবানবন্দী প্রদানে সহায়তা করেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম নিমাই চন্দ্র দাশ। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৬২ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম - রঘুদত্তকাঠি, থানা- কচুয়া, জেলা- বাগেরহাট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ২০ বছর। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে আমরা জানতে পারি মাওলানা একেএম ইউসুফ, বাগেরহাটের রজব আলী, সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারসহ জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতারা কচুয়ায় আসবে শান্তি কমিটি গঠন করার জন্যে। তারা মে মাসে এসে আমাদের ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি স্থানীয়ভাবে রাজাকারদের সংগ্রহ করে আমাদের ৭ নং বাধাল ইউনিয়ন কমিটি গঠন করে। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে আরো বলেন, যেদিন তারা মিটিং করেছিল মিটিং শেষে সেদিন কচুয়া সদরের আশপাশের গ্রাম আন্ধার মানিক, খালিশা খালী, চরকাঠি, বারইখালীসহ বিভিন্ন গ্রামে আগুন দেয়। আমাদের এলাকা হতে আনুমানিক ২৫/৩০ জনকে খুলনায় রাজাকারে ট্রেনিং নেয়ার জন্য পাঠানো হয় তাদের মধ্যে ছিলেন মজিবুর মোল্লা, আতাহার আলী মোল্লা, লতিফ তালুকদার, আকরাম খান, ইদ্রিস শেখসহ আরও অনেকে। ট্রেনিং শেষে তারা ফিরে এসে দৈবজ্ঞহাটি বিশ্বাস বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ওই ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আকরাম খান। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর থেকে আশপাশের এলাকায় লুটতরাজ চালায় এবং নির্যাতন শুরু করে। এই অবস্থায় ৪ জুন আমরা কয়েকজন ভারতে চলে যাই। ভারতের বসিরহাট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে জুলাই মাসের ৭/৮ তরিখের দিকে আবার ফিরে আসি। জুলাই মাসের শেষের দিকে ঐ রাজাকার ক্যাম্পের লোকজন শাঁখারী কাঠি গ্রামে সনাতন দাশের বাড়িতে হিন্দুদের মুসলমান বানানোর জন্য তাদের দাওয়াত দেয়। হিন্দুদের বলা হয় তারা মুসলমান হলে ভারতে যেতে হবে না এবং তাদের মারাও হবে না। আমরা দূর থেকে দেখি যে সনাতন দাসের বাড়িতে গরু জবাই করে মাংস রান্না হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০০/২৫০ জন মুসলমান হয়ে মাথায় টুপি পরে গরুর মাংস খায়। সেখানে ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার আকরাম খানসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। মৌলভী মকবুল খান হিন্দু থেকে যারা মুসলমান হয় তাদের নামাজ পড়ায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের ৪ নবেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে ওই রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করি। ওই সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির কারণে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে আসি। ৫ আশ্বিন শুক্রবার বিকাল বেলা আমি অমূল্য, দেবেন ও যতীন দেবনাথ শাঁখারী কাঠি বাজারে যাই। আমরা বাজারে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি হাটের দক্ষিণ দিক হতে আনুমানিক ৫০/৬০ জন রাজাকার শাঁখারী কাঠি বাজারের দিকে আসছে এবং বাজারে উপস্থিত হয়ে বাজারের তিনটি পথ আটকে দেয়। তখন সিরাজ মাস্টার হাটে আসা লোকদের উদ্দেশে বলে ‘তোমরা কেউ পালাবে না। তোমাদের কোন ভয় নেই। হাটে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা যারা দৈবজ্ঞহাটি ক্যাম্প আক্রমণ করেছে তাদের আমরা ধরতে এসেছি। আমি ও আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ কোটাল হাটে অবস্থিত মসজিদের ভেতরে লুকিয়ে থেকে দেখতে পাই যে, রাজাকাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে আটক করে যতীন্দ্র নাথের গামছার দোকান থেকে গামছা নিয়ে এসে ঐ গামছা দিয়ে তাদের দুজনকে বেঁধে ফেলে। রাজাকারদের মধ্যে যাদের চিনতে পারি তাদের মধ্যে ছিল ইদ্রিস মোল্লা, রুস্তম মোল্লা, মজিবর, ইদ্রিস শেখ, আকরাম খান, লতিফ তালুকদার, বাবর আলী, মুসলেম মেম্বার, নোনা। সাক্ষী বলেন, এক পর্যায়ে সিরাজ মাস্টার বাঁশি বাজায়। রাজাকাররা আটক লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমি তখন একটি ধান ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে পড়ি। ওই ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়।
×