ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শতাধিক নৌকায় কয়েক শ’ নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ

বন বিভাগের তেল সংগ্রহ কর্মসূচী ॥ তেল সরাচ্ছে মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বন বিভাগের তেল সংগ্রহ কর্মসূচী ॥ তেল সরাচ্ছে মানুষ

বাবুল সরদার, সুন্দরবন থেকে ফিরে ॥ “আমরা তো দুইদিন ধরে তেল উঠাচ্ছি। আগে নামিনি ভয়তে, যদি কেই কিছু কয়। বন আমাগো, আমরা বন দিয়া বাঁইচ্যা থাহি, এই নদীর পানি খাই, এহানে আমরা জন্মইছি, বড় হইছি। তেলে ক্ষতি হবে, তা আমাগো ক্ষতি, তাই আমরা সবাই তেল উঠাচ্ছি....।” শনিবার দুপুরে সুন্দরবনের চাঁদপাই এলাকায় মৃগমারী খালপারে কুদ্দুস হাওলাদার এ কথা বলেন। চাঁদপাই রেঞ্জ অফিসের ঠিক উল্টোদিকে জয়মনি গ্রামে তাঁর বাড়ি। তিনি দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় বনের খাল থেকে তেল সংগ্রহ করে পদ্মা অয়েলের স্থানীয় ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করতে আসেন। এ সময় সেখানে তাঁর মতো অনেক নারী-পুরুষকে তেল সংগ্রহ করে বিক্রি করতে দেখা যায়। সেখানে থাকা ফাতেমা জানান, তিনি তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তেল আহরণ করছেন। শুক্রবার ৩৬০ টাকা এবং শনিবার দুপুরে ৪৮০ টাকার তেল বিক্রি করেছেন। এরা সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেল সংগ্রহে অংশ নিয়েছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এদিন সুন্দরবনে সরেজমিন পরিদর্শনের এক পর্যায়ে চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারী খালপারে পৌঁছান। তিনি তেল ক্রয়কেন্দ্রের এবং তেল অপসারণের কাজে থাকা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এবং নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজের তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের মারাত্মক কোন ক্ষতি হবে না। আমরা বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে কিছু ক্ষতি হলেও ভয়াবহ কোন ক্ষতি হবে না। ভাসমান তেল আহরণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে তেল অপসারণ অত্যন্ত কার্যকর একটি পদক্ষেপ। তেল অপসারণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। শনিবার সকাল থেকে বন বিভাগের উদ্যোগে শতাধিক নৌকায় স্থানীয় কয়েক শ’ নারী-পুরুষ বনের নদী-খাল থেকে স্বতঃস্ফূর্ত তেল আহরণের কাজ করছে। এদিন পর্যন্ত আট হাজার লিটার তেল অপসারণ করা হয়েছে। রবিবার থেকে একাজ আরও জোরদার করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী জানান, পরিবেশের ছাড়পত্র না পাওয়ায় তেল অপসারণে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাছাড়া ভাসমান তেলের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় এখন কেমিক্যাল পাউডার ব্যবহারের বাস্তবতা নেই। তিনি ‘অয়েল কালেকশন প্রোগ্রামে’ জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নৌমন্ত্রী আরও বলেন, তেলের কারণে সুন্দরবনে এখন পর্যন্ত খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। জলজপ্রাণীর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। শুকনো মৌসুম থাকায় এবং খালের মুখে জাল দিয়ে বাঁধা দেয়ায় তেল বনের ভেতর তেমন বেশি বিস্তৃত হতে পারেনি। অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকার কারণেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী বলেন, বাগেরহাটের চাঁদপাই রেঞ্জে নৌরুট বন্ধ করা হবে কিনা এ বিষয়ে রবিবার আন্তঃমন্ত্রালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ‘শ্যালা নদীর নৌরুট সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় মংলা বন্দরের ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পণ্য ওঠানামা করতে সমস্যা হচ্ছে। ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে শ্যালা নদীর রুটটি ব্যবহার করতে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ঘষিয়াখালীর চ্যানেলের খনন কাজ শুরু হয়েছে, আগামী এক বছরের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ সময় বর্তমান শ্যালা নদীর রুটটি বন্ধ করে কচিখালী বা সুপতি হয়ে বিকল্প রুট চালু করার বিষয়টি সরকার খতিয়ে দেখছে বলে তিনি জানান। তাঁর মতে, কচিখালী বা সুপতির বড় নদী হয়ে আপাতত নৌযান চলাচল করলে ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম থাকবে। তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিম কাজ করছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে যুক্ত উভয় জাহাজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিদর্শনকালে মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের প্রধান মোঃ নুরুল করিম, মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভুঁইয়া, নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের প্রধান যুগ্ম-সচিব নূরুন রহমান, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুঃ শুকুর আলী, পুলিশ সুপার নিজামুল হক মোল্যা, কোস্টগার্ড মংলাস্থ ঘাঁটির সিও ক্যাপ্টেন কাজী মেহেদী মাসুদ প্রমুখ। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুঃ শুকুর আলী ও সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, দ্রুত তেল অপসারণে ২০০ শ্রমিক কাজ করছে এবং স্থানীয় জনসাধারণ অংশগ্রহণ করছেন। এ ব্যাপারে মাইকিংসহ নানা প্রচার চালানো হচ্ছে। তেল অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এ ‘অয়েল কালেকশন প্রোগ্রাম’ চলবে বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। এদিকে, সুন্দরবনের অয়েল ট্যাঙ্কারডুবির পর শ্যালা নদীর রুট বন্ধের ফলে মংলা বন্দরে আসা ২ শতাধিক লাইটারেজ জলযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মংলাবন্দর হারবার মাস্টার খান মোঃ আখতারুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চত করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মংলা বন্দরের জন্য ক্রেনযুক্ত শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজ থাকা জরুরী। দক্ষিণ উপকূলের প্রায় তিন কোটি মানুষের প্রাকৃতিক সুরক্ষায় সুন্দরবনকে বাঁচাতে দরকার অয়েল সুইপার জলযান। জেলেরা জানান, শ্যালা নদীতে ডলফিনের অভয়াশ্রমে আগের মতো ডলফিন দেখা যায়নি। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, ইরাবতিসহ সুন্দরবনের ৬ প্রজাতির ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন যদি সুন্দরবন ত্যাগ করে তবে অবাক হবার কিছুই থাকবে না। সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ করতে সুন্দরবন বিভাগ গত ৩ বছরে ৭ বার পত্র দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ’কে। সুন্দরবন বিভাগের ওই সব চিঠিতে জাহাজ চলাচলে শ্যালা নদীতে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতি ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বা ইকোসিস্টেমে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে বলা হয় বলে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী জানান। সুন্দরবন রক্ষায় মানববন্ধন ॥ সুন্দরবনের অভ্যন্তর রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ, ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেল দ্রুত অপসারণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দাবিতে শনিবার দুপুরে বাগেরহাটের শরণখোলায় মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুন্দরবন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (আইপ্যাক) শরণখোলা রেঞ্জের উদ্যোগে এ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ মিনারসংলগ্ন সড়কে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচীতে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন সহ-ব্যস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন, সুন্দরবন রক্ষা কমিটি সভাপতি নজরুল ইসলাম, মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান ফরাজী ও পিপল্স ফোরামের সভাপতি তুহিন বয়াতি। সুন্দরবন ও জলজপ্রাণীর তেমন ক্ষতি হবে না- নৌমন্ত্রী স্টাফ রিপোর্টার খুলনা অফিস থেকে জানান, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। নদীতে যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে তা ফার্নেস অয়েল। এই তেল পেট্রোল-ডিজেলের চেয়ে কম ক্ষতিকর। ফার্নেস তেলের প্রভাবে সুন্দরবন ও জলজ প্রাণীর তেমন ক্ষতি হবে না। তিনি বলেন, স্থানীয় পদ্ধতিতে নদী থেকে তেল তুলে ফেলা হচ্ছে। আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যে তেলের কার্যকরিতা থাকবে না এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শনিবার সন্ধ্যায় খুলনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে একথা বলেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে রামপাল-মংলা আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক ও খুলনা সদর আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান উপস্থিত ছিলেন। দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এটা সরকারের উদাসীনতা নয়। আমরা সবসময় ঘটনাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং ঘটে যাওয়া সমস্যা সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। অয়েল ট্যাঙ্কার সাউদার্ন স্টার সেভেনকে আঘাতকারী জাহাজ এমভি টোটালকে নারায়ণগঞ্জে অটক করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে দুর্ঘটনার খবর একটু বিলম্বে পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল পলি জমে ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে এই নৌপথটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পথ ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। বিগত কোন সরকার ঘষিয়াখালী চ্যানেল ড্রেজিং করেনি। যার দায়ভার আমাদের সরকারের ঘাড়ে এসে পড়েছে। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে ১১টি ড্রেজার কিনেছে। তার মধ্যে ৫টি মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খননের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে এই নৌপথটি চালু করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
×