ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমি বুকের ভেতর হাহাকার জাগায়

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বধ্যভূমি বুকের ভেতর হাহাকার জাগায়

বধ্যভূমি মানে বুকের ভেতর হাহাকার তোলা বিভীষিকাময় কাঁপন। বধ্যভূমি মানে নাম না জানা অসংখ্য মৃত স্বজনের অস্তিত্বের তীব্র জানান। অধ্যাপিকা হামিদা রহমান ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘কাঁটাসুরের বধ্যভূমি’ নামে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘আর একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল। শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনও অল্প মাংস আছে। বোধহয় চিল-শকুন খেয়ে গেছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো ধুলো-কাদায় মিলে গিয়ে নারীদেহের সাক্ষ্য বহন করছে। আর একটু এগিয়ে যেতেই একটা উঁচুস্থানে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। আমি উপরে উঠতেই এক ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমাকে উপরে উঠিয়ে নিলেন। সামনে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নয়, একেবারে বারো-তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে। পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া মানুষটি হলো ডাক্তার রাব্বী।... মাঠের পর মাঠ চলে গেছে। প্রতিটি জলার পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোককে যে এ মাঠে হত্যা করা হয়েছে। একই বছরের ৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি নিয়ে আনিসুর রহমানের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে কুটি কুটি করে কাটা বুদ্ধিজীবীদের হাড়ের ছবিও ছাপা হয়। বধ্যভূমির সেই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করছেন, ‘...অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়ীতে তাহলে দেখতে হতো না ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। অনুসন্ধিৎসু হিসেবে যা দেখাও কোনো মানুষের উচিত নয়। ওখানে না গেলে গায়ে ধরত না এমন দহনজ্বালা। সহ্য করতে হতো না ভয়-ক্রোধ, ঘৃণা মিশ্রিত এমন তীব্র অনুভূতি, যে অনুভূতি বলে বুঝাবার নয়।’ মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে এসে শত্রুপক্ষ তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশব্যাপী সংঘটিত করে পৈশাচিক হত্যাকা-। বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউ-ই তাদের এই হত্যাকা- থেকে রেহাই পায়নি। বিজয়ের পর ঢাকাসহ সারাদেশে এসব হত্যাকাণ্ডের স্থান আবিষ্কৃত হতে থাকে। উদ্ধার করা হয় কঙ্কাল। হাড়গোড়। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা নিয়ে ‘শতাব্দীর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটন করেছে আল-বদর বর্বর বাহিনী’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার আনন্দ, উচ্ছ্বাসের মাঝে গতকাল শনিবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরীতে করুণ ছায়া নেমে আসে। মুক্তির আনন্দকে ছাপিয়ে ওঠে কান্নার রোল। শতাব্দীর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ঢাকা নগরী ও বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারি থেকে। তা আরো চরম হয়ে উঠেছিল মুক্তির পূর্বক্ষণে। ...গতকাল রায়েরবাজার ও ধানম-ি এলাকার বিভিন্ন গর্ত থেকে প্রচুরসংখ্যক লাশ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে অধ্যাপক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের লাশও রয়েছে। এ পর্যন্ত কতিপয় লাশ চেনার উপায় নেই।’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বধ্যভূমি চিহ্নিত করার কাজে যারা জড়িত তাদের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার ৪২ বছরে সারাদেশে প্রায় ৫ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান ও চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে মোট বধ্যভূমির সংখ্যা কত তার প্রকৃত হিসাব এখনও নির্ধারণ করা যায়নি। তবে বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি জানায়, মুক্তিযুদ্ধের পর সারাদেশে খুঁজে পাওয়া বধ্যভূমিগুলো (কিলিং ফিল্ড) যাতে নতুন প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপিত হতে পারে সে ব্যাপারে কমিটি একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কমিটির আহ্বায়ক ডাঃ এমএ হাসান জানান, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এজন্য তৈরি হয়েছে গ্লোবাল পারসেপশন বা জিপিএস ম্যাপ। তিনি আরও জানান, দেশে ৫ হাজারের মতো বধ্যভূমি রয়েছে, যার মধ্যে সর্বাধিক সত্তরটি রয়েছে ঢাকা শহরে। এর মধ্যে আবার শুধু মিরপুরেই রয়েছে তেইশটি বধ্যভূমি কিন্তু তার মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে মাত্র তিনটি। জিপিএস পদ্ধতিটি করা হয় সর্বভারতীয় ফরেনসিক সোসাইটির মাধ্যমে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও রয়েছে বলে কমিটি জানায়। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি জানায়, দেশে ৫ হাজার বধ্যভূমি থাকার প্রাথমিক তথ্য পেলেও কমিটি নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৯৪৫টি বধ্যভূমি থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছে। জানা যায়, আবিষ্কৃত বধ্যভূমির সঠিক নজরদারি ও সংরক্ষণের অভাবে কোথাও কোথাও তা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। দখলকৃত এসব বধ্যভূমি প্রভাবশালীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে তৈরি করছে ঘরবাড়ি। এছাড়া নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অনেক বধ্যভূমি। গাইবান্ধা স্টেডিয়াম সংলগ্ন বধ্যভূমিটি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এই বধ্যভূমির পাশে স্টেডিয়ামে বর্বর পাকসেনারা জেলার প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে গোটা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসহায় নারী-পুরুষ ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করত। পরে এই গণকবরটিতে পুঁতে রাখা হতো। ডিসেম্বরে গাইবান্ধাসহ সারাদেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর এই বধ্যভূমিতে মেয়েদের কাটা হাত-পা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অসংখ্য মানুষের হাড় পাওয়া গেছে। এই বধ্যভূমির পাশে এখন বসানো হয়েছে মদের ভাঁটিখানা। এই ভাঁটিখানা উচ্ছেদের জন্য একাধিক মিছিল, মিটিং ও নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত তা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জের লালচামার বাঁধের বধ্যভূমি যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সাঘাটা হাইস্কুলসংলগ্ন ওয়াপদা বাঁধের বধ্যভূমিতে অবৈধ দখলদাররা বাড়িঘর তুলে বসবাস করছে। পটুয়াখালী শহরের তিনটি বধ্যভূমির অবস্থা খুবই নাজুক। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের দাবি থাকলেও এসব বধ্যভূমিতে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। নেত্রকোনায় ১২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অরক্ষিত এসব বধ্যভূমিতে নির্মাণ করা হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। অযতœ-অবহেলায় ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে অথবা নদীগর্ভে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গীত মানুষজনের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি। জানা যায়, নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে গণকবরটি অবহেলায় পড়ে আছে। ১৬ ডিসেম্বর এলে বধ্যভূমিগুলো একটু পরিষ্কার করা হয়। বছরের বাকি সময় এগুলো অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকে। গণকবর সংলগ্ন পাউবোর আবাসিক কোয়ার্টার থেকে ময়লা-আবর্জনা ফেলে প্রতিনিয়ত গণকবরকে নোংরা করা হয়। আর গণকবরের এসব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজটি করছে স্থানীয় চিত্রা থিয়েটারের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। জানা যায়, সারাদেশে চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেদখল ও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার দেশে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ লক্ষ্যে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭১ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা এবং অন্যান্য সুপারিশের মাধ্যমে প্রাপ্ত ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে সরকারী জমি পাওয়া গেছে। বাকি ১৪৭টি বধ্যভূমির জন্য জমি কিনতে হবে, যার অর্থায়ন করা হবে প্রকল্প ব্যয় থেকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি বধ্যভূমির জন্য ১০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে ১৯৩টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা থেকে ১৭টি বধ্যভূমির নাম বাদ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকাতে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় পরে তা চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি। জল্লাদখানা বধ্যভূমি সূত্র থেকে জানা যায়, বধ্যভূমি সংস্কার, সংরক্ষণ ও মেরামতের পুরো কাজটি তদারক করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে মিরপুরের এই বধ্যভূমিটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এই বধ্যভূমিতে নিহত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৭৭ জনের নাম পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে বধ্যভূমির প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণের কাজটি কষ্টসাধ্য ও দুরূহ। বেসরকারী কয়েকটি গবেষণা সংস্থার আন্তরিক সহযোগিতায় মন্ত্রণালয় বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণের কাজটি সারাদেশে করে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন উল্লেখযোগ্য সম্মুখ সমরের স্থানগুলোর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গত বছর ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা ধার্য করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁরা বধ্যভূমি সংরক্ষণ, সংস্কার ও উন্নয়নের বিষয়ে জানান, বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কর্মসূচীর প্রশংসা করেছেন এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষারও তাগিদ দিয়েছেন।
×