ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দ্বন্দ্ব-কোন্দল, গ্রেফতার আতঙ্ক ॥ ৫ বছরেও জাতীয় কাউন্সিল নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

দ্বন্দ্ব-কোন্দল, গ্রেফতার আতঙ্ক ॥ ৫ বছরেও জাতীয় কাউন্সিল নেই

শরীফুল ইসলাম ॥ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করতে বাধ্য। কিন্তু ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতীয় কাউন্সিল করছে না বিএনপি। নির্বাচন কমিশন থেকে বার বার তাগাদা দিলেও আরপিওর তোয়াক্কা করছে না দলটি। জানা যায়, জাতীয় কাউন্সিল না করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে বিভিন্ন অজুহাত দেখালেও মূলত সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই তা করতে পারছে না বিএনপি। ৫ বছর ধরে জাতীয় কাউন্সিল করতে না পারায় একদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও অন্যদিকে দলকে ঢেলে সাজাতে পারছে না এ দলটি। এ জন্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, আরপিও অনুসারে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি ছাড়া সব দলই নির্ধারিত সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করেছে। আর এ কারণেই কমিশনের পক্ষ থেকে বিএনপিকে কাউন্সিল করার ব্যাপারে বেশ ক’বার তাগাদা দেয়া হয়েছে। অবশ্য বিএনপি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কয়েকবার সময়ও চেয়ে নিয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। কাউন্সিল করার জন্য তখন ভেন্যুও ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু কাউন্সিলকে সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারাদেশের সকল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল বেড়ে যাওয়ায় ওই যাত্রায় আর জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি হাইকমান্ড। এর পর বেশ ক’দফা চেষ্টা চালিয়েও জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি। এক পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কাউন্সিলের পরিবর্তে সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এ বছর ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে নতুন উদ্যমে আবার জাতীয় কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতির মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি আমেজ সৃষ্টি করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার কৌশল নেয়া হয়। এ জন্য সাংগঠনিক জেলাগুলো পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নেতাদের প্রতি আস্থা না থাকায় জেলা নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে বৈঠক করে কমিটি পুনর্গঠন শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট জেলার কেন্দ্রীয় নেতারা পুনর্গঠিত জেলা কমিটির নেতাদের অসহযোগিতা করতে থাকেন। তাই নতুন করে জেলা পর্যায়ে কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে ডজনখানেক জেলা কমিটি গঠনের পর এ প্রক্রিয়ায় কমিটি পুনর্গঠনের কাজ স্থগিত করেন খালেদা জিয়া। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সারাদেশে উপজেলা নির্বাচন থাকায় বিএনপি হাইকমান্ড এ নির্বাচনের পর জাতীয় কাউন্সিল করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের পর উদ্যোগ নিয়েও কাউন্সিল করতে পারেনি। বর্তমানে সর্বস্তরে দলে যে ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে তাতে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সুদূরপরাহত। জানা যায়, দলের বিভিন্ন স্তরে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, মামলার কারণে সিনিয়র নেতারা গ্রেফতার আতঙ্কে থাকা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপি হাইকমান্ড হতাশ হয়ে পড়ছে। আর এ কারণেই আপাতত বিএনপি হাইকমান্ড জাতীয় কাউন্সিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় কাউন্সিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ কর্মসূচী পালন করতে হলে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের সক্রিয় উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা কোন্দল-সংঘাতে লিপ্ত। অনেক জল্পনা- কল্পনার পর মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করা হলেও এ কমিটি হওয়ার পর ঢাকা মহানগর বিএনপির অবস্থা আরও নাজুক হয়। এ কারণে ইচ্ছে করলেও বিএনপি ঢাকায় দলের জাতীয় কাউন্সিল করতে পারবে না। আর করতে গেলেও কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের দাঙ্গাহাঙ্গামা বেঁধে যেতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী পালনকালে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাসহ বেশ ক’টি মামলায় জড়িয়ে পড়েন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির বেশ কয়েক সিনিয়র নেতা। বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেয়ায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যে মানহানি মামলা হয় তার রায়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আর জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হলে তাঁকেও গ্রেফতার করা হতে পারে বলে দলের সিনিয়র নেতারাই আশঙ্কা করছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি না পারছে আন্দোলনে যেতে এবং না পারছে জাতীয় কাউন্সিল করে দল গোছাতে। সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব রেখে দলের ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই বছর ৬ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেন খালেদা জিয়া। এর পর থেকে তিনি ভালভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টিকে দলের নেতাকর্মীরা ভাল চোখে দেখেননি। তাই পরবর্তীতে জাতীয় কাউন্সিল হলেও মির্জা ফখরুল ভারমুক্ত মহাসচিব হতে পারবেন কি না তা কেবল চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ওপরই নির্ভর করবে। এদিকে কাউন্সিল না হওয়ার কারণে দলের অনেক ত্যাগী নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। এ কারণে সুযোগবঞ্চিত বিএনপি নেতাদের ক্ষোভ বাড়ছে। তবে জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য অনুকূল পরিবেশ না এলে বিএনপি হাইকমান্ড সরাসরি কমিটি পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে পারেন। এ জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নিজ নিজ অবস্থান থেকে ফাইলওয়ার্ক করছেন বলে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জনকণ্ঠকে বলেন, আরপিও অনুসারে জাতীয় কাউন্সিলের সময় পেরিয়ে গেছে। তবে কবে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হবে সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, আরপিও অনুসারে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা থাকলেও নানামুখী সমস্যার কারণে আমরা তা করতে পারছি না। বিএনপি একটি বড় দল। তাই এ দলে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। তবে আমরা সমস্যা কাটিয়ে উঠে এক সময় জাতীয় কাউন্সিল করতে সক্ষম হব।
×