ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

ফিরোজ মান্না ॥ বিষাক্ত তেলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের বনভূমি সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি উঠেছে। কাজটি দ্রুত না করতে পারলে কয়েক শ’ প্রকার প্রাণী মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। ইতোমধ্যে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তেলের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে পশুপাখি। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় পাখির ‘প্যারা পাখি’ অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। জোয়ার ভাটায় সুন্দরবনের ভেতর ৪শ’ ৫০টি নদ-নদী ও খালে তেল ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বনের প্রায় ১ হাজার ৮৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনে বিদেশী সহযোগিতার দাবি জানিয়েছে পরিবেশবিদরা। সূত্র জানিয়েছে, বনের দক্ষিণ দিকের তিনটি এলাকা ২০১১ সালে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। ওই এলাকাতেই তেল ছড়িয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের পূর্বদিকের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে এই দুর্ঘটনা ঘটায় সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে পড়েছে ইরাবতী ডলফিন। এই এলাকায় দিনে রাতে দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়। তেল এখন উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে। ডলফিনের বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি ২০-২৫ মিনিট পর শ্বাস নেয়ার জন্য গভীর পানি থেকে উঠে আসে। ফার্নেস অয়েলের ঘনত্ব মবিল, ডিজেলের মতো। ফলে পানির উপরিস্তরে ছড়িয়ে থাকা তেলের জন্য অক্সিজেন নিতে সমস্যায় পড়েছে ডলফিনগুলো। তবে এখন পর্যন্ত কোন ডলফিনকে মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়নি। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) ঘোষণা করে ইউনেস্কো। এই ঘোষণার পর এর পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু যে আকারে কাজ করার কথা সেই আকারে কাজ হচ্ছে না। যদিও কয়েকটি প্রকল্প বনে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পগুলোও চলছে ধীর গতিতে। ট্যাংকার ডুবে যাওয়ায় সুন্দরবনের শ্যালা, চাঁদপাই, দুধমুখী ও ধানসারি নদীতে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে জলজ প্রাণী ছাড়াও সুন্দরবনের সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান ও গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ কিছু দিনের মধ্যে মরক রোগে আক্রান্ত হবে। পরিবেশবিদ বিপ্রদাস বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, সুন্দরবনে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতি এক দিনে বোঝা যাবে না। এর প্রভাব ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত থাকবে। তেলগুলো এখনই তুলে নিতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমুদ্র বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগের শিক্ষকরা তেল অপসারণের কাজ করতে পারেন। এমন কি নৌ-বাহিনীর কারিগরি দক্ষতা রয়েছে। তাদেরও কাজে লাগানো প্রয়োজন। যতদ্রুত কাজটি করা যাবে ততই বনের জন্য মঙ্গল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যায়। ইরাক যুদ্ধে পারস্য উপসাগরে এমন একটি জাহাজ ডুবে মহা-বিপর্যায় নেমে এসেছিল। সেখানে দীর্ঘদিন মেয়াদী প্রভাব ছিল। উত্তর কোরিয়াতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। আটলান্টিক মহাসাগরে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর সেখানে লাখ লাখ পেঙ্গুইন পাখি মারা যায়। এই প্রভাব দীর্ঘদিন ছিল। সুন্দরবন নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। অবহেলা করলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নেবে। বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে। কিছু দিন পরে আর ডলফিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এখন যেহেতু অতিথি পাখি আসছে-এই অতিথি পাখিগুলো পানির ওপরের খাবারের সঙ্কটে পড়বে। তারা খাবার না পেয়ে মারা যাবে। জোয়ারের সময় পানি উপরে উঠবে এবং ভাটার সময় গাছে, মাটিতে লেগে থাকবে তেল। জমে থাকা সেই তেলই মাটি এবং পানির মাছ-প্রাণী, গাছ-পালার জন্য চরম বিপদ ডেকে আনবে। পরিবেশবিদ ইনাম আল হক জনকণ্ঠকে বলেন, বনের সব ধরনের প্রাণী চরম ক্ষতির শিকার হবে। উদবিড়াল, শুশুক, পাখি প্রাণ নিয়ে থাকতে পারবে না। মারা যাবে। হরিণের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও অন্যান্য প্রাণীকুল মহা-বিপদে পড়ে যাবে। যত দিন তেল পানির ওপর ভাসবে ততদিন বন এলাকার সব কিছুই মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। পরিবেশবিদরা বলেন, অপার সৌন্দর্যের এই বনভূমির ওপর মানব সৃষ্ট বিপর্যয় একের পর এক বনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই বনটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’। সম্প্রতি বনের একটি নদীতে তেল ভরা জাহাজ ডুবে গোটা এলাকায় বিষ ছড়িয়ে গেছে। এখন তেল পশুর-বলেশ্বর নদীর পানিকেও কালো করে তুলেছে। বিষে আক্রান্ত হয়েছে ৮শ’ ৮৭ প্রজাতির প্রাণী। মরণ কামড় দিয়েছে বিষাক্ত তেল ৩শ’ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডের ওপর। আর এই কামড় ১৫ থেকে ২০ বছর ধরেই চলতে থাকবে। দীর্ঘমেয়াদী দূষণ বহন করতে হবে সুন্দরবনকে। পরিবেশবিদরা বলেন, এ কালো তেল ছড়িয়ে পড়লে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। সে ক্ষেত্রে অক্সিজেনের অভাবে সমস্যায় পড়বে জলজ প্রাণীকুল। এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব পুরো সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করে দেবে। এখনই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূলে তেলের আবরণ পড়ছে। এই আবরণ সহজে সরে যাবে না। এর জন্য বিশেষ কোন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনের অভয়াশ্রম। বিষাক্ত তেলের তেজষ্ক্রিয়ায় ডলফিন প্রজাতিসহ জলজ ও সুন্দরবনের প্রাণীকুলের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
×