ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে এখনই পদক্ষেপ নিন ॥ বান কি মুন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে এখনই পদক্ষেপ নিন ॥ বান কি মুন

কাওসার রহমান, লিমা, পেরু থেকে ॥ বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো আজ বহুমুখী বিপর্যয়ের মুখে। সেই বিপর্যয়ের হাত থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে রক্ষার পূর্ণপ্রস্তুতি নিয়ে আগামী বছর প্যারিস যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। লাতিন আমেরিকার পর্যটন শহর লিমায় বিশ্বজলবায়ু সম্মেলনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী বৈঠকের উদ্বোধন করতে গিয়ে জাতিসংঘের এ অভিবাবক বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে বিশ্বের ধনী-গরিব সকল দেশকে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দরজা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সুযোগ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তাই শেষ সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বের সকল দেশকে এ জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানে অংশীদার হতে হবে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সমাজের সকল মানুষকে। তিনি বলেন, এখন সময় নয় দোষাদোষীর। এখন সময় এই ভয়ানক সমস্যা থেকে উত্তরণের। আর এ সমস্যা সমাধানে সকল দেশকে অবশ্যই সমঝোতার মনোভাব নিয়ে এগুতে হবে। নিজ নিজ দেশের কার্বন হ্রাসের বিস্তারিত কর্মসূচী নিয়ে প্যারিস যেতে হবে। যাতে সব দেশ মিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় আইনী চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। সবুজ জলবায়ু তহবিলে উন্নত দেশগুলোর এক হাজার কোটি ডলার প্রদানের ঘোষণাকে জাতিসংঘ মহাসচিব স্বাগত জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কার্যক্রমে কাজে আসবে। তবে এখনও যে সব উন্নত দেশ সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থায়ন করেনি তাদের অর্থায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। উন্নত দেশগুলোর অন্যতম অস্ট্রেলিয়া এখনও সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রদানের ঘোষণা না দেয়ায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো ২০২০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। জাতিসংঘ মহাসচিব সেই অঙ্গীকার পূরণের জন্যও উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। পাহাড় মহাসাগর আর বৃক্ষরাজির অপূর্ব সমারোহে সাজানো দেশ পেরু। এ দেশটিরই সাজানো গোছানো রাজধানী শহর লিমায় মঙ্গলবার শুরু হয়েছে শেষ ধাপের জলবায়ু আলোচনা। এতে যোগ দিয়েছেন ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা। এই প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে রয়েছেন এক শ’রও বেশি মন্ত্রী। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হতে যাওয়া জলবায়ু চুক্তির (প্যারিস প্রোটোকল) খসড়া কাঠামো নিয়ে চূড়ান্ত দরকষাকষি হবে আগামী চার দিন। আর এ দরকষাকষি নিজে উপস্থিত থেকে তত্ত্বাবধান করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। আশা করা হচ্ছে, তাঁর নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তন রোধকারী চুক্তির কাঠামো নিয়ে দরকষাকষি গতি পাবে। আর সব দেশ প্যারিসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছাবে। বান কি মুন জলবায়ু পরিবর্তনকে মানবসৃষ্ট মহাদুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রতিরোধী হতে হবে। কিন্তু যা করার করতে হবে এখনই। এখনও সময় আছে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার। কিন্তু এ সুযোগ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।’ বান কি মুনের বক্তব্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং এলডিসির মুখপাত্র ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ এতোদিন যে কথাগুলো বলে আসছে, জাতিসংঘ মহাসচিব সেটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তার বক্তৃতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবিগুলোর যৌক্তিকতা আছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ শুরু থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে দেনদরবার করে আসছে। তাই বাংলাদেশ বর্তমান এবং ভবিষ্যত জলবায়ু সম্মেলনে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে।’ স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় জলবায়ু সম্মেলনের হাইলেভেল সেগমেন্ট খ্যাত নীতিনির্ধারণী বৈঠক শুরু হয়। পেরুর প্রেসিডেন্ট ওলান্তা হুমালা তাসো সকালে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর বিভিন্ন দেশের পরিবেশমন্ত্রীরা একে একে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরে নীতিনির্ধারণী সভায় বক্তৃতা করেন। দিনভর এ বক্তৃতা পর্ব চলে। বাংলাদেশের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে এ হাইলেভেল সেগমেন্টে বক্তৃতা করবেন। সব সময় বাংলাদেশ হাইলেভেল সেগমেন্টে প্রথম দিনেই বক্তৃতা করে আসছেন। এবার দ্বিতীয় দিন অপরাহ্নে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সন্ধ্যার পর শুরু হয় নতুন আইনী কাঠামোর খসড়া নিয়ে আলোচনা। সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত এ আলোচনা চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ মুহূর্তের জলবায়ু আলোচনা দুটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এ বিষয় দুটি হলোÑ প্যারিস প্রোটোকলের কাঠামো প্রণয়ন এবং কোন দেশ কে কি পরিমাণ কার্বন হ্রাস করবে তার ঘোষণা। যা বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পযুগ থেকে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সাহায্য করবে। তবে এই কঠিন কাজটি করতে হলে উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো বড় আকারে কার্বন কমানোর দিকে যেতে হবে। এজন্য পরিত্যাগ করতে হবে সস্তার জৈব জ্বালানি। তার পরিবর্তে গ্রহণ করতে হবে ব্যয়বহুল পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। অনেক উন্নয়নশীল দেশ চাচ্ছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হোক। কিন্তু এতে শঙ্কিত তেল সমৃদ্ধ ওপেক দেশগুলো। তাঁদের শঙ্কা উন্নত বিশ্ব ক্রমান্বয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে গেলে তাঁদের আয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে অস্ট্রেলিয়া ॥ জাতিসংঘ মহাসচিবের সমালোচনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড বা সবুজ জলবায়ু তহবিলে ১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। হাইলেভেল সেগমেন্টে বক্তৃতা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশমন্ত্রী ঘোষণা দেন। অস্ট্রেলিয়ার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে উন্নয়নকর্মীরা। তারা বলেছে, সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পদক্ষেপ। উল্লেখ, সকালে হাইলেভেল সেগমেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অন্যতম উন্নত দেশ হয়েও এখন পর্যন্ত সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রদান না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
×