ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৭১ : গণহত্যা ও নির্যাতন শীর্ষক বিশেষ প্রদর্শনী জাদুঘরে

তুম মুক্তি হ্যায়, তুম আওয়ামী হ্যায় চিত্রে পাকি নির্যাতন

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

তুম মুক্তি হ্যায়, তুম আওয়ামী হ্যায় চিত্রে পাকি নির্যাতন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার কোন এক সড়কে স্থির হয়ে আছে একটি গাড়ি। ভেতরে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর দেহ নিয়ে স্টিয়ারিংয়ের ওপর লুটিয়ে পড়েছেন গাড়িচালক। এ দৃশ্যের পাশেই ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে শরণার্থী শিবিরে চিৎকার করছে নিষ্পাপ শিশুটি। চোখে যেন তার বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত হওয়া নীলাভ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পাশের ছবিতে দেখা যায় রাস্তার ধারে বসিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক নিরপরাধ মানুষকে। তাঁদের বুকের ওপর কষিয়ে লাথি মারছে বুটজুতো পরা এক পাকসেনা। নিষ্ঠুর ওই পাকি সেনা সদস্যের জিজ্ঞাসা : ‘তুম মুক্তি হ্যায়, তুম আওয়ামী হ্যায়?’ পাশের আলোকচিত্রে হানাদার বুলেটে বিদীর্ণ শিশুর রক্তাক্ত শরীরকে জলে ধুয়ে পরিষ্কার করছে তার পিতা অথবা কোন আপনজন। এর পরের ছবিটি যেন আরও অমানবিক। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি লাশের মাংস খুবলে খাচ্ছে শিয়াল ও কুকুর। এই বিবরণগুলো দেয়া হলো অনেক ছবি থেকে তৈরি একটি কোলাজ আলোকচিত্র থেকে। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে শুরু হওয়া ১৯৭১ : গণহত্যা ও নির্যাতন শীর্ষক বিশেষ প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে এমন অনেক ছবি। একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বগাথার উল্টোপিঠে ঘটে যাওয়া পাকবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস প্রভৃতি বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের সাক্ষী এই প্রদর্শনী। ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে গবেষণায় উঠে আসা ৬ লাখ বীরাঙ্গনার আত্মদানের স্মারক এ প্রদর্শনী যেন মনে করিয়ে দেয় কত ত্যাগ, কত বিসর্জন আর কতটা অমানবিকতার ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি। অনেক ত্যাগের মহিমায় একাত্তরে বিজয়ী হয়েছিল বাঙালী। তবে পঁচাত্তরের পর কৌশলে সেই বিজয়টাকে ছিনিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। এখনও অব্যাহত আছে সেই অশুভ তৎপরতা। ৩০ লাখ শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। চলছে গণহত্যা ও নির্যাতনের ভয়াবহতাকে তুচ্ছ ঘটনা হিসেবে তুলে ধরার অপতৎপরতা। আর এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহতের প্রধান উপায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা ও নির্যাতনের কথা বার বার তুলে ধরা। সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে জাতীয় আত্মপরিচয়ের গৌরবজনক অধ্যায়ের সঙ্গে মিশে থাকা অমানবিক নির্যাতন ও গণহত্যার নীল বেদনার চিত্রটি। এ লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বেদনাক্লিষ্ট দিকটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। মঙ্গলবার হেমন্তের বিকেলে ‘১৯৭১ : গণহত্যা ও নির্যাতন’ শীর্ষক আট দিনব্যাপী এ বিশেষ প্রদর্শনীর সূচনা হয়। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত গণহত্যার ৩০টি নিদর্শন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন রচিত ৭০টি গ্রন্থ এবং বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মের অনুকৃতি ও গণহত্যার আলোকচিত্রের সমন্বয়ে প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে। সম্মানিত অতিথি হিসেবে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ এবং জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম আজিজুর রহমান। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ এবং জাদুঘরের সম্পাদক ডাঃ শেখ বাহারুল আলম। জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি এম আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। আলোচনার শুরুতে একাত্তরের বীর শহীদদের স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। এরপর উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা পরিবেশন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পারি দেব রে’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়।’ শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রদর্শনীর গুরুত্ব তুলে ধরে মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও যুদ্ধ নিয়ে তিন হাজার বই রচিত হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গণহত্যা ও নির্যাতন। অথচ এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়নি। যে কোন আলোচনায় শুধু বিজয়ের বিষয়টিকেই বড় করে বলা হয়। এর কারণও আছে। সেটা হলো বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল। এরপর একটু ব্যাখ্যা দিয়ে এই ইতিহাসবিদ বলেন, বিজয় মানুষ মনে মনে রাখে কিন্তু সে স্মৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখনই মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায় এর বিরুদ্ধশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ১ কোটির বেশি লোক মারা গিয়েছিল। সে কারণে আজ পর্যন্ত তাদের চলচ্চিত্রে চিত্রকলায় সেই গণহত্যার নিদারুণ পরিণতির কথা তুলে ধরা হয়। এমনকি সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন স্থানে হলোকাস্ট মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে। তারা ভুলতে দেয়নি গণহত্যা কী জিনিস। আমরা আমাদের দেশে এই গণহত্যার কথা ইতোমধ্যে ভুলতে শুরু করেছি। আর সে কারণেই আমরা এই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য কাজ করছি। আমি মনে করি এ বিষয়টি তুলে ধরতে পারলে আমাদের দেশে কোন প্রকারের অপরাজনীতি স্থান পাবে না। স্ব^াধীনতার পক্ষে এবং বিপক্ষের লোক একসঙ্গে বাস করার মতো শ্রীহীন পরিবেশ থাকবে না। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১০০ নম্বরের একটি কোর্স করা চালু করার দাবি জানান। এ ছাড়াও তিনি ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় নির্যাতন কেন্দ্র মোহাম্মদ শরীরচর্চা কেন্দ্রে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সঙ্গে যৌথভাবে স্মৃতিফলক স্থাপনের কথা উল্লেখ করেন। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর এই দেশটা উল্টো দিকে চালাতে শুরু করা হয়। মুনতাসীর মামুন ঢাকার বাইরে যে কাজ শুরু করেছেন-সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের জাদুঘরে নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। আক্ষেপ করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের শুত্রুপক্ষ সব সময় সংঘবদ্ধ কিন্তু আমরা এমনটি হতে পারিনি। তাদের মতো আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারিনি। বিশাল একটা জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সত্ত্বে¡ও বিভেদ ভুলে আমরা এক হয়ে কাজ করতে পারি না। স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরেও কীভাবে স্বাধীনতা বিপক্ষের শক্তি মানুষের ভোট পায়, মন্ত্রী হয়, দেশ পরিচালনা করে এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর তিনি শামসুর রাহমানের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতা থেকে কয়েক লাইন আবৃত্তি করেন। গ্যালারিজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে একাত্তরের নির্যাতনের স্মৃতিতাড়িত নানা ছবি ও চিত্রকর্মের প্রতিকৃতি। একটি আলোকচিত্রে উঠে এসেছে বয়সের ভারে মুখে অসংখ্য বলিরেখা ফুটে ওঠা একটা বৃদ্ধা ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আরেকটি ছবিতে সহায়-সম্বল নিয়ে শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশ্যে গ্রাম ত্যাগ করছে একদল গ্রামবাসী। আছে পঁচিশে মার্চের ধ্বংস হওয়া রমনা কালীবাড়ির সেই সময়ের চিত্র। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে আছে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ। পুরনো ঢাকার শাঁখারীবাজারের সড়কে পড়ে আছে অজ্ঞাত পরিচয় লাশটি। একাত্তরের ২০ মে খুলনার চুকনগরের গণহত্যা প্রাণ হারিয়ে ২০ হাজার মানুষ। গণকবরের ছবির মাধ্যমে সেটিও উপস্থাপিত হয়েছে প্রদর্শনীতে। আছে ঝিনাইদহের শৈলকুপার গণকবর। আবার কোন ছবিতে দৃশ্যমান গণকবর থেকে তোলা হাড়গোড় ও মাথার কঙ্কাল। ফসলে মাঠে পড়ে থাকা লাশের সারি বা শহরের সড়কে লাশের স্তূপ এমন ছবিগুলো যেন বলে যায় শুধুই বেদনার কথা। পেছন থেকে দৃশ্যমান নির্যাতনের শিকার বস্ত্রহীন নারীর ছবিটি যেন বলে যায় কতটা আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। এসব আলোকচিত্রের সঙ্গে আছে শিল্পী হাশেম খানের ২৪টি ড্রইংসহ দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের ড্রইং ও চিত্রের প্রতিলিপি। আছে নির্যাতনের চিত্রপটে উদ্ভাসিত কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, আব্দুস শাকুর শাহ, হামিদুজ্জামান খান, মুস্তাফা মনোয়ার প্রমুখ শিল্পীর চিত্রকর্মের প্রতিলিটি। আর যাঁদের আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনী তাঁরা হলেন- কিশোর পারেখ, রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, নিখিল ভট্টাচার্য, হারুন হাবীব, শ্যামা দাস বসু, বীরেন সেনগুপ্ত ও এমএস শফি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনী। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×