ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাটহাজারীর মাদ্রাসার বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

হাটহাজারীর মাদ্রাসার বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ভুয়া রসিদ ছাপিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা এর বিপুল পরিমাণ অর্থের গন্তব্য অজানা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে শৌচাগার। বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং চরম স্বেচ্ছাচারিতা। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক জন্মতারিখ ব্যবহার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ। সর্বশেষ খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নে সম্পৃক্ত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জামেয়া অদুদিয়া সুন্নীয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার বিরুদ্ধে উঠে আসে উপরোক্ত অভিযোগগুলো। এ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও চরম অনিয়মের ফিরিস্তি বেশ দীর্ঘ। মাদ্রাসাটির গবর্নিং বডির প্রায় সব সদস্য সরকার ও স্বাধীনতাবিরোধী এবং একই পরিবারভুক্ত হওয়ার কারণে অধ্যক্ষ হিসেবে পুনঃনিয়োগ পেয়েছেন অবসরে যাওয়া মুহাম্মদ সৈয়দ হোসাইন। মাদ্রাসার শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তার পুনঃনিয়োগ বাতিলের দাবি থাকলেও তিনি বহাল রয়েছেন গবর্নিং বডির সমর্থনে। মাদ্রাসাটির এক সিনিয়র শিক্ষক নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা তথ্য তুলে ধরেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে প্রেরিত এক আবেদনে। লিখিত অভিযোগ ও সংযুক্ত বিভিন্ন ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়Ñ বর্তমানে গবর্নিং বডির চার সদস্য ও অধ্যক্ষ একই পরিবারের এবং তারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। সঙ্গত কারণেই অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসাইন গবর্নিং বডির খুবই আস্থাভাজন। ফলে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও তাকে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এর প্রতিবাদ করে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরা। মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তপূর্বক যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে তাতে মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ ও গবর্নিং বডির ওপর সন্দেহের তীর জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়েও। মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের শিক্ষা পরিদর্শক আবু সুলতান মোঃ আবু সুলতান মোহাম্মদ একে সাব্রী ও সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মোঃ হেমায়েত উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে (২৩/১০/২০১৪) বলা হয়, অভিযোগ তদন্তে আইনগত কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও অধ্যক্ষ মুহম্মদ সৈয়দ হোসাইন তাঁর নিজের বিষয়ে আনীত অভিযোগ তদন্তে সহযোগিতা করেননি। বরং অসহযোগিতা করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মচারী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য বলে মতমত ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৬০ বছর পূর্তির পর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার বিষয়ে সরকারের অনুমোদন নেই। অথচ, তিনি চুক্তিভিত্তিক হিসেবে নিয়োজিত থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়োগের বিধিগত কোন বৈধতা নেই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনেক শিক্ষক-কর্মচারী জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও তার আস্থাভাজন কয়েক শিক্ষক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করে মাদ্রাসার নামে বিরাট অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করেন। এ অর্থের শতকরা ২৫ ভাগ সংগ্রহকারীরা নিয়ে থাকেন। বাকি টাকা জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এ পর্যন্ত মাদ্রাসাটির কতজন শিক্ষক কতবার বিদেশে গেছেন, এ ব্যাপারে সরকারের তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন অনুমোদন নিয়েছেন কিনা এবং কত টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে তা যাচাই করা প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টি অতীব জরুরি হওয়া সত্ত্বেও অধ্যক্ষের অসহযোগিতার কারণেই তা তদন্ত করা যায়নি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে রাজাকারদের সহায়তায় এ মাদ্রাসাটিকে ক্যাম্প বানিয়েছিল হানাদার বাহিনী। সেখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, সাধারণ মানুষদের এনে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যে স্থানটিতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে সেটিকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ দূরের কথা, উল্টো সেখানে বানানো হয়েছে শৌচাগার। এতেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। মাদ্রাসাটির প্রগতিশীল শিক্ষকরা জানান, এখানে জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয় না। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিরও অবমাননা করেছেন অধ্যক্ষ। এ দুটি ছবির ওপর কাগজ দিয়ে ঢেকে বিশ্রি ভাষায় মন্তব্য করার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে বিভিন্ন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে অধ্যক্ষের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং জন্মতারিখ নিয়েও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যক্ষ তার প্রথম চাকরিজীবনে জন্ম তারিখ দেখান ০১-০৯-১৯৫১ সাল। আর অদুদিয়া মাদ্রাসায় জন্মতারিখ দেখান ০১-০৯-১৯৫৩ সাল। তার শিক্ষাগত সনদ অর্জনেরও ধারাবাহিকতা নেই। তিনি দাখিল ও আলিম পাস করেন ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সালে। এরপর নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ফাযিল এবং প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কামিল ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৭৮ ও ১৯৮৭ সালে। তিনি করণিক হতে জুনিয়র মৌলভী, জুনিয়র মৌলভী হতে সহকারী মৌলভী এবং সহকারী মৌলভী থেকে প্রভাষক না হয়ে সরাসরি অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অথচ, অধ্যক্ষ হতে হলে প্রভাষক পদে দশ বছর বা ফাযিল শ্রেণীতে কমপক্ষে দশ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ফাযিল ও কামিল পাস না করে ফাযিল শ্রেণীতে কিভাবে তিনি দশ বছর পড়ালেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফলে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরাসরি অধ্যক্ষ হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অদুদিয়া মাদ্রাসার গবর্নিং বডিতে রয়েছেন সভাপতি বদরুল আলম চৌধুরী, তার ভাই অহিদুল আলম চৌধুরী, আপন ভগ্নিপতি আবুল কাশেম চৌধুরী এবং অহিদুল আলম চৌধুরীর মেয়ের জামাই ডাঃ রাশেদুল হাসান। তন্মধ্যে কেবলমাত্র আবুল কাশেম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হলেও তিনি নিরুপায়। অধ্যক্ষের আরেক সহযোগীর নাম শিক্ষক আবদুল হালিম। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির পাশাপাশি দ্বৈত সনদের অভিযোগ। নথিতে দেখা যায় তিনি একই বছরে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে কামিল এবং বিএ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। একই ব্যক্তি কি করে একই শিক্ষাবর্ষে দুটো ডিগ্রী অর্জন করতে পারেন তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী খোরশেদ আলম, বদরুল আলম, মীর আবুল কাশেম সিদ্দিকীসহ অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে অনিয়মের। সংঘবদ্ধ এ কমিটি ও শিক্ষকদের কাছে অসহায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকরা। ইতোমধ্যেই প্রতিবাদ ও ভিন্নমত পোষণ করে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন একাধিক শিক্ষক। মাদ্রাসটিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে উদ্ধারের জন্য শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
×