ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফারুক আহমেদ

অপারেশন গোয়ালন্দ ফেরিঘাট

প্রকাশিত: ০২:৪১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

অপারেশন গোয়ালন্দ ফেরিঘাট

একাত্তরে আমার বয়স ছিল ১৯ বছর। বাবা ছিলেন রাঢ়িখাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই বাবার বন্দুক নিয়ে আমার পাখি শিকার ও ফুটবল খেলার অভ্যাস ছিল। একাত্তরে বয়সে ছোট ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার গ্লানি ও স্বাধীনতার স্বাদ বোঝার মতো জ্ঞান ছিল। এপ্রিল মাসে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা গাজী সামসুদ্দিনের নেতৃত্বে বিশজনের গ্রুপ মিলে কুমিল্লা বর্ডার হয়ে শালবন জঙ্গল দিয়ে হেঁটে নৌকায় অনেক বিপদের মধ্য দিয়ে রাতে কুমিল্লা মাচ্ছাখালী, বক্সনগর হয়ে ভারতের কংগ্রেস ভবন ও মেলাঘর দুই নং সেক্টর মেজর এটিএম হায়দারের ক্যাম্পে পৌঁছি। দশদিন ট্র্যানজিট ক্যাম্পে অবস্থান করার পর ভারতের নৌবাহিনীর রিক্রুটিং টিম নির্বাচনক্রমে আমি স্পেশাল ট্রেনিংয়ের জন্য একজন সুইসাইড বীর নৌকমান্ডো নির্বাচিত হই। এর আগে আমি ফ্রিস্টাইল সাঁতারে ভারতের রোদ্রসাগর নদীতে চতুর্থ স্থান লাভ করি। তিন শ’ ছেলের মধ্য থেকে ত্রিশজনকে বাছাই করা হয়। ত্রিশজনকে আগরতলা দুই নং সেক্টর থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারযোগে নরসিংঘর এয়ারপোর্ট থেকে গোহাটি এয়ারপোর্ট থেকে দমদম এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বাসযোগে পশ্চিমবঙ্গে পলাশীতে নিয়ে যায়। ভারতের নৌবাহিনীর লেঃ কমান্ডার জর্জ মার্টিস ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জ। ট্রেনারদের মধ্যে ছিলেন গুপ্ত বাবু, আইসিং, চমন সিং, কিরণ সিং, দাশ বাবু। সর্বমোট সাতজন পূর্ব পাকিস্তানের পুরাতন নেভির বাঙালী আটজন সাব-মেরিনার ফ্রান্সে প্রশিক্ষণে ছিলেন। তাঁরা ফ্রান্স থেকে দিল্লীতে পালিয়ে আসেন। তাঁরাও নৌকমান্ডো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১০নং সেক্টর নাম দিয়ে গোপনে নৌযুদ্ধ পরিকল্পনা করেন ভারতের নেভি পলাশীতে রাতদিন বিরামহীনভাবে চলছে ট্রেনিং। আমাদের গ্রুপে ছিল ষাট নৌকমান্ডো। আমাদের সকাল ৬টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পায়ে ফিন্স পরে সাঁতারকাটা, পিটি প্যারেড, আর্মস কমব্যাট, জুডো, শ্যূটিং, মাইন, হ্যান্ডগ্রেনেট, স্টেনগান, বাটগান, রাইফেল, এসএলআর, ড্যাগার, পিস্তল, এলএমজি ইত্যাদি গান চালনা শেখানো হতো। পায়ে ফিন্স পরে দুই-তিন মাইল ভাগীরতি নদীর স্রোতে সাঁতারকাটা, একঘণ্টা খাবার সময় আবার এমুনেশন বিস্ফোরক ক্লাস, এক বছরের ট্রেনিং; অল্প সময়ে রাতদিন তিন মাসে শেষ। অধিক স্পেশাল ট্রেনিং। অক্টোবরে পলাশী ভারত থেকে পুরনো-নতুন মিলে নব্বই নৌকমান্ডোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীবন্দরে, সাগরে অপারেশনের জন্য পাঁচ-দশ জনে ভাগ করে পাঠায়। ফরিদপুর গোয়ালন্দঘাটের ফেরিডুবিয়ে আমি নতুন জীবন পাই এবং যুদ্ধের খেতাব পদক থেকে বঞ্চিত হই। আমার রণাঙ্গনের সাথি মোঃ খবিরুজ্জামান (বীরবিক্রম) ফরিদপুর টেকেরহাটে ফেরি ডোবাতে গিয়ে শহীদ হন । সে কথা মনে হলে আজও আমার বুক ভারি হয়ে ওঠে। ভারত নেভি আমাকে এমন ট্রেনিং দিয়েছিলÑওয়ান টাইম টিস্যু গায়ের গামছা বা টাওয়েল না ধুয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহার করা যাবে। যুদ্ধের টার্গেট না হয় তুমি। নাম দিলেন সুইসাইড বীর নৌকমান্ডো। যুদ্ধে যাবে কিন্তু ফিরে আসতে পারবে না। শত্রু দেখে ফেললে তার মোকাবিলা করার মতো কোন হাতিয়ার আমার কাছে ছিল না। শুধু পায়ে ফিন্স, সাঁতার কাটার জন্য পেটে বাঁধা লিমপেট মাইন। হাতে বাঁধা শিপের গায়ে শেওলাকাটার জন্য ব্যানেট, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি লিমপেট মাইনগুলো জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছিল। মাইনের ওজন পাঁচ কেজি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মাইনগুলো যুগোসøাভিয়ায় অব্যাহত ছিল। ভারত সরকার ১৯৭১ সালে নৌকমান্ডোদের ব্যবহারের জন্য মাইনগুলো এনেছিল। এগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী, একটি মাইনশিপের জন্য। দশ নং সেক্টর নাম দিয়ে গোপনে যুদ্ধ পরিচালনা করে ভারতের লে. কমান্ডার জর্জ মার্টিস। অপারেশন ছিল খুবই গোপনীয়। যুদ্ধের সময় সব মিলিয়ে পাঁচ শ’ নৌকমান্ডো ছিল। যুদ্ধে পঁচিশজন শহীদ হন। আমরা যুদ্ধে গুঁড়িয়ে দিয়েছি ১২৬টি যুদ্ধজাহাজ ও পরিবহনশিপ ফেরিসহ। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে নৌকমান্ডোদের দ্বারা পানিতে তলিয়ে দেয়া জাহাজগুলো উত্তোলন শুরু করে রাশিয়া ও স্যালভেজটিম। যুদ্ধের নানা স্মৃতিতে আজও স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। যুদ্ধদিনের এবং যুদ্ধপরবর্তী নানা কথা স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে ওঠে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অর্জন-বিয়োজন সবই হৃদয়কে ব্যথিত করে। আমি একদিন এক আমেরিকান বৃদ্ধকে বলেছিলাম, তোমার বয়স কত? সে বৃদ্ধ পকেট থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার আইডি কার্ড না দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আইডি কার্ড আমার হাতে দিয়েছিল। সে কার্ডে লেখা আমেরিকান সোলজার, ভিয়েতনাম। তার আইডি কার্ড দেখে-পড়ে আমার অনেক দুঃখকষ্ট হয়েছিল। আমি বাঙালী, আমি আমার দেশ স্বাধীন করেছি; আমার কাছে এই ধরনের আইডি কার্ড থাকার কথা। আমার রণাঙ্গনের সাথী ছিল নৌকমান্ডো মোঃ মতিউর রহমান। মতিউর রহমান আমার হাইস্কুলের বন্ধু। যুদ্ধের ২৪ বছর পর তিনি পদক পেয়েছিলেন। একাত্তরের পয়লা অক্টোবর। আমার ওপর নির্দেশ ছিলÑপদ্মা নদীর গোয়ালন্দঘাটের ফেরি এবং এক ধরনের অয়েল ট্যাঙ্কার, যা দ্বারা জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো, আমার গ্রুপ ঐ নির্দিষ্ট রাতে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দঘাটের যে পাশে পাকিস্তানী আর্মি অবস্থিত তার বিপরীত তীরে হাজির হই। আমারই সাথী আলমগীর শিকদার সাহসী কমান্ডো, গোয়ালন্দ ফেরিঘাট রেকি করে আসে। আলমগীর ঝুরিতে মরিচের চারা মাথায় নিয়ে বিক্রি করার অভিনয় করে রেকি করে আসে। আমার গ্রুপে চার নৌকমান্ডো ছিল, আটজন ল্যান্ড গেরিলা ইপিআর গাইড ছিল। ওরা আমাদের গাইড দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোয়ালন্দঘাটে। পদ্মা নদীর পারে গিয়ে দেখি একটি ফেরি, একটি টার্কি সেখানে। তার ওপর সার্চলাইট নিয়ে পাকিস্তানী সৈনিকরা হেভি মেশিনগানসহ পাহারায় ছিল। আমার বাড়ি পদ্মা নদীর পারে থাকায় ঐ এলাকা ভালভাবে চেনা ছিল। আমি ও আমার সঙ্গীরা ফেরির আধা মাইল উজানে এসে নিজেদের তৈরি করে নিই। আমি মানসিকভাবে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলাম। যে করেই হোক ফেরিতে আমাকে মাইন লাগাতেই হবে। আমার প্ল্যান ছিল, মাইন লাগানোর পর আমি পদ্মা নদীর স্রোতে ভাগ্যকুল ও লৌহজংয়ে চলে যাব। ভোর চারটার দিকে আমরা তিনজন পানিতে নামি। ঠিক করা হয়, দুইজন টার্কির দিকে যাবে আর আমি যাব ফেরির দিকে। তিনজন একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে যখন এগুতে থাকি তখন গোয়ালন্দঘাটের ওপর থেকে সার্চলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ে আমাদের মুখের ওপর। আমরা একফুট পানির নিচে চলে যাই এবং পানির নিচ থেকে উপরে তাকাই। উপরে সার্চলাইটের আলো থাকায় পানি লাল দেখা যায়, যখন কালো দেখা যায় তখন আমরা তাড়াতাড়ি নাক ভাসিয়ে দম নিয়ে পানির নিচে চলে যাই। এভাবে ১০/১৫ মিনিট করার পর এক চরের কোলে ঢুকে পড়ে একঘণ্টা পানির কিনারে শুয়ে থাকার পর ইশারায় আমি ফেরির দিকে চলে যাই। আলমগীর শিকদার ও মুনা টার্কির দিকে চলে যায়। ফেরিতে মাইন লাগানোর পর আমি চরের কোলে ঢুকে পড়ি। পলিমাটি নরম থাকায় আমি উপরে উঠতে পারছিলাম না। আধা ঘণ্টা পর মাইন বার্স্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়ে যায়। আমি আমার শরীর পলিমাটির নিচে নিয়ে যাই। আধা ঘণ্টা পর গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ভোর হতে থাকে। আমি পানির ভাটিতে লম্বা সাঁতার দেয়ার চিন্তা করি পদ্মা নদীর ঐ পারে যাওয়ার। আমার নিরাপত্তা ছিল যত উজানে যেতে পারি। হঠাৎ একটি মাছ ধরার নৌকা দেখতে পাই। ইশারায় বলি, আমাকে বাঁচান পানিতে পড়ে গেছি। মাছ ধরার নৌকা আমার কাছে আসতেই একজন বলে ওঠে-উনার কাছে যন্ত্র আছে, আমাদের বিপদ হতে পারে, এই বলে নৌকা ঘোরাতে থাকে। আমার অনুরোধে ওরা আমাকে নৌকায় তুলে নেয়। ভারত থেকে যে আট ইপিআর গাইড আমাদের গোয়ালন্দঘাটে নিয়ে গিয়েছিল তারাই গোয়ালন্দ মুক্তিযোদ্ধা, বলেছিল নদীর কিনার থেকে নৌকমান্ডো উঠবে। আমাকে সাহায্য করার জন্য গোয়ালন্দের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদীর বিভিন্ন সাইটে ওঁৎ পেতে ছিল। অপারেশনের সাতদিন পর রণাঙ্গনের সাথীদের খুঁজে পাই। কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ভারতে রওনা হই। যাওয়ার সময় ৩০ অক্টোবর রাজবাড়ির রেললাইন ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেই। যুদ্ধকালীন ৭৫ রুপী ট্রেনিং এ্যালাউন্স পেয়েছিলাম, যা দিয়ে বাবার জন্য একটা তুষোর চাদর কিনেছিলাম। সেই চাদরটা লুঙ্গি দিয়ে পেঁচিয়ে মাথায় রাখতাম। যুদ্ধ শেষে বাবা চাদরটা পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলেন। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, বীর নৌকমান্ডো
×