রহিম শেখ, রাজশাহী থেকে ॥ প্রতিবছরই কৃষকেরা মৌসুমের সময় পচনের ভয়ে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, আদা কম দামে বিক্রি করেন। উৎপাদন খরচ উঠাতে না পেরে পথে-ঘাটে-রাস্তায় ফেলেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন কৃষকেরা। এসব কাঁচাপণ্য মৌসুমে সংরক্ষণ করতে না পেরে লোকসানে কৃষি কাজে আগ্রহ হারিছে ফেলেছেন অনেক কৃষক। তবে এবার কৃষকদের শষ্য সংরক্ষণে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক হিমাগার। সৌর বিদ্যুত ও প্রকৃতির বাতাসকে কাজে লাগিয়ে বাঁশ, খড়, ইট, বালু ও সিমেন্টের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে ৩শ’ টন ধারণক্ষমতার এই প্রাকৃতিক শস্য সংরক্ষণারগার। মাত্র ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরবঙ্গের শস্যভা-ার খ্যাত রাজশাহীর বোয়ালিয়ার চকপাড়ায় এটি স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে শুক্রবার সকালে দেশের প্রথম প্রাকৃতিক এই হিমাগারটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গবর্নর বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে যতটি প্রাকৃতিক হিমাগার করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তার সমপরিমাণ প্রাকৃতিক হিমাগার করা হবে। যদি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক একটি হিমাগার করে তবে বাংলাদেশ ব্যাংকও একটি হিমাগার করবে। তিনি বলেন, এটিকে প্রাকৃতিক হিমাগার না বলে প্রাকৃতিক শস্য সংরক্ষণাগার বলা যেতে পারে। এটি চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতির বাতাসকে এখানে কাজে লাগানো হয়েছে। এখানে যে কয়েকটি ফ্যান লাগবে তাও চলবে সৌরশক্তির মাধ্যমে। তিনি বলেন, এর ধারণক্ষমতা ৩শ’ মেট্রিক টন। এই সংরক্ষণাগারটি তৈরিতে খরচ হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ টাকা। অথচ একই ধারণক্ষমতার একটি প্রচলিত ধারার হিমাগার তৈরি করতে খরচ হয় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। সেখানে বিদ্যুতেরও দরকার হয়। এদিক থেকে এটি একটি ব্যয়সাশ্রয়ী সংরক্ষণাগার। স্বল্প আয়ের কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য কম টাকায় এ সংরক্ষণাগারে রাখতে পারবে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, উত্তরবঙ্গকে বাংলাদেশের শস্যভা-ার বলা যায়। এ অঞ্চলের ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, শাক-সবজি ও ফলমূল সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এসব উৎপাদিত ফসলের বেশিরভাগই পচনশীল। স্বল্প আয়ের কৃষকেরা প্রচলিত ধারার হিমাগারে উচ্চমূল্যে উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করতে পারে না। ফসল ফলানোর পর তা সংরক্ষণে এ ব্যয় তাদের সাধ্যের বাইরে। তাই মৌসুমের সময় চাহিদার চেয়ে সরবরাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তারা ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে তাদের ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই দেখি, কৃষকেরা মৌসুমের সময় পচনের ভয়ে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, আদা কম দামে বিক্রি করে লোকসান গুনছে। কেউ কেউ আলু, টমেটো, মূলার উৎপাদন খরচ উঠাতে না পেরে পথে-ঘাটে-রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বা গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছে। যে কৃষকেরা কষ্ট করে উৎপাদন করে তারা দাম না পেলেও এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী ঠিকই এসব পণ্য কেনা- বেচার মাধ্যমে মোট অঙ্কের মুনাফা করছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও পীড়াদায়ক।
কৃষকদের এমন দুর্দশা দেখেই একটি ব্যয়সাশ্রয়ী শস্য সংরক্ষণাগার তৈরির ভাবনা আমার মাথায় আসে। সেই ভাবনা থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেনকে অনুরোধ করি একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার তৈরি করতে। তিনি বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের কৃষকের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের জন্য এমন হিমাগারের আরও দরকার। এছাড়াও দরকার কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের। এ লক্ষ্যে মফস্বলে শস্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে ব্যাংকার ও সামর্থ্যবান উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। রাজশাহীর প্রাকৃতিক এই হিমাগারটির নাম শাহ সিরাজুল ইসলাম প্রাকৃতিক হিমাগার করার ঘোষণা দেন গবর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের (রাজশাহী) নির্বাহী পরিচালক জিন্নাতুল বাকেয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এম ওসমান গনি, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দিন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম শাহ্ নওয়াজ আলী, প্রাকৃতিক হিমাগারের উদ্ভাবক ও প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. এম মনজুর হোসেন, প্রকৌশল কাজে সহায়তাকারী প্রফেসর ড. নিয়ামুল বারী প্রমুখ। প্রাকৃতিক হিমাগারের উদ্ভাবক ও প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. এম মনজুর হোসেন জানান, ৩০০ টন ধারণক্ষমতার প্রাকৃতিক হিমাগারটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, খড়, ইট, বালু ও সিমেন্ট। হিমাগারটির বাইরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৬০ ফুট এবং ৩০ ফুট, ভেতরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৫৮ ফুট ও ২৮ ফুট এবং উচ্চতা ২৭ ফুট। হিমাগারটি করতে সময় লেগেছে ৩ মাস। হিমাগারে আলু ও গাজর চার থেকে পাঁচ মাস, টমেটো দুই থেকে তিন মাস, আম এক থেকে দেড় মাস, লিচু ১৫ দিন থেকে এক মাস, পেঁয়াজ ও রসুন চার থেকে ছয় মাস এবং আদা সাত থেকে আট মাস সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানান মনজুর হোসেন। হিমাগারটির কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি জানান, হিমাগারটির দেয়াল ও টালির মাঝখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা। ফাঁকা অংশে বালু ও পানি থাকবে। এখান থেকে জলীয়বাষ্প তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের তাপ শোষণ করা হবে। নিচতলা থেকে ঠা-া বাতাস যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে ওপরে উঠে যায় সেজন্য দেয়ালের নিচের দিকে কিছুটা ফাঁকা রাখা হয়েছে। এই ফাঁকা দিয়েই বাইরের গরম বাতাস ভেতরে ঢুকে প্রাকৃতিকভাবে ঠা-া বাতাসকে ঠেলে ওপরে নিয়ে যাবে।