ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন থেমে নেই

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন থেমে নেই

বাংলাদেশের প্রধান পার্বত্য অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সমভূমির গড় উচ্চতা ১২০ ফুট থেকে ১৩০ ফুট। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্বে ভারতের মিজোরাম, দক্ষিণ-পূর্বে-মিয়ানমারের (বর্মার) আরাকান প্রদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা। আয়তন ৫০৯৮ বর্গমাইল বা ১৩১৮১ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট এক-দশমাংশ। জেনারেল জিয়াউর রহমান ইনসার্জেন্সি দমনে সামরিক পন্থা গ্রহণ করেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। দেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান গেরিলা হামলা, অন্যদিকে বিদ্রোহ দমনে সামরিক অভিযানের পরিণতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্ত জনপদ হত্যা, ধ্বংস, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং স্বামী-সন্তানহারা মা-বোনসহ, আবালবৃদ্ধবনিতার ক্রন্দন ও আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে। বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা কোন নৈতিকতা মানেনি। ফৌজি শাসক পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে নিছক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছে। জিয়া ও তাঁর উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাকিস্তানী শাসকদের মতোই সাম্প্রদায়িকতা ও বৃহৎ জাতিসুলভ মনোভাব আচ্ছন্ন। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর নেতৃবৃন্দ, বিশেষত, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতির সমন্বয়ে ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা ও উগ্র মাওবাদী চিন্তাধারাও ছিল হঠকারী এবং দেশের বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা না করে ১৯৭৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বাঙালী অভিবাসন শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সভাপতিত্বে এক গোপন বৈঠকে ৩০ হাজার বাঙালী পরিবারকে পার্বত্যাঞ্চলে পুনর্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং এর জন্য ৬৫ কোটি টাকাও বরাদ্দ করা হয়। ১৯৮১ সালে ১ লাখ বাঙালী পরিবারকে ৫ একর জমি ও নগদ ৩ হাজার ৬শ’ টাকা দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষাধিক। বর্তমানে পাহাড়ীর চাইতে বাঙালীর সংখ্যা অনেক বেশি। জেনারেল এরশাদ শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, ফলে কিছু সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তাঁদের আকর্ষণীয় চাকরিসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সমঝোতার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন-’৮৯ প্রণয়ন করেন। তার ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের উপমন্ত্রীর মর্যাদা, দফতর-বাসস্থানে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা হয়। কিন্তু জেনারেল এরশাদ পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন-১৯৮৯ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। জেনারেল এরশাদের ধারাবাহিকতায় বিগত ’৯১-০৬ সময়ের বিএনপি সরকারের আমলে কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা শুরু করে ১৯৯২ সালে। সেখানেও স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে আসে। কর্নেল অলির নেতৃত্বে কমিটি ১৩ বার বৈঠক করেছে যার কয়েকবার হয়েছে ভারতে, ঢাকায় কোন বৈঠক বসতে পারেনি। তাদের আমলেই যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছেÑ যা এখনও বহাল রয়েছে। বিএনপির সেই কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেননের ১৯৯৭ সালে ভোরের কাগজে প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে এ স্বীকৃতি পাওয়া যায় যে, তারা স্বায়ত্তশাসন দিতে পর্যন্ত রাজি ছিল। কর্নেল অলি এক ধাপ এগিয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়া উচিত। শেখ হাসিনা সরকারের তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে যে কমিটি করেছিল তাতে বিএনপিদলীয় দু’জন সদস্য ছিল কিন্তু তাদের দল থেকে কমিটিকে সহযোগিতা প্রদানে বিরত রেখেছে। চুক্তিতে কি আছে, তা না দেখেই বিএনপি এর বিরোধিতা শুরু করেছিল। এমনিভাবে যেদিন চুক্তি স্বাক্ষর হবে সেদিন হরতাল। পরে অবশ্য নমনীয় হয়ে চুক্তি দেখে হরতাল দিয়েছিল। তারা কেন চুক্তি করতে পারেনি তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে তাদের ব্যর্থতার জায়গায় শেখ হাসিনা সরকারের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল। দীর্ঘ ৪ দশকের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর একটি বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭। চুক্তি স্বাক্ষর করেন তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য নেতা সন্তু লারমা। বর্তমান সরকার মাত্র এক বছর চেষ্টা করে একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছেছে ২ ডিসেম্বর ’৯৭ স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তি তাদের পক্ষেই সম্ভব, যাদের আছে দেশ ও জাতির কাছে অঙ্গীকার এবং যারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এ চুক্তিতে দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটা অতীতে যারা উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের চাইতে বেশি নয় বরং আরও অনেক কম দিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি। তারাও ক্লান্ত, কতকাল আত্মগোপনে থাকবে? শেখ হাসিনার সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে মাত্র। কোন রাষ্ট্রের উপাদান ৪টি যথা- ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণ করেন সরকার। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করার জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উদাহরণ টানা যায়। ২৬ মার্চ ’৭১ স্বাধীনতা দিবস কিন্তু হানাদার পাকবাহিনী ভূখণ্ড দখলে রেখেছিল বিধায় একমাত্র থানায় ছিল পাকিস্তানী পতাকা। আর অধিকাংশ এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল এবং মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ এ চূড়ান্তভাবে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণের সুযোগ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিল সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে। গত দু’দশক (’৭৫-৯৬) পার্বত্য ২৫টি থানা, জিলাশহর, ক্যান্টনমেন্ট, সীমান্ত চৌকিতে বাংলাদেশের পতাকা ও নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের বিরাট এলাকা ছিল শান্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যার সহজসরল অর্থ উল্লিখিত এলাকায় আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ছিল না। জজ আদালত ছিল না। ২ ডিসেম্বর ’৯৭ স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে রাজি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ হলো। জেলা জজ আদালত এখন বিচারিক দায়িত্ব পালন করছে। এর চাইতে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। (জনকণ্ঠে ২৭.১২.৯৭ তারিখের সরদার সিরাজুল ইসলামের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত)। পার্বত্য চুক্তি হওয়ার আগে বিএনপির আচরণে প্রবল আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থী নেতা বদরুদ্দীন উমর লিখেছিলেন (আজকের কাগজ ১৭.১১.৯৭)। ‘বিএনপির লক্ষ্য সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-ভাবনাকে বিপজ্জনকভাবে জনগণের মধ্যে সংশ্লিষ্ট করা যে ধরনের রাজনৈতিক আবর্জনা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে তার থেকে অন্য কিছু আশা করার সুযোগ নেই।’ শান্তি চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছিলেন, ‘এই শান্তি চুক্তির ফলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে প্রায় ২৫ বছর পর সংঘাত সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে। এতে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার কথা রয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রায় সবাই স্বাগত জানিয়েছে। ব্রিটেনও স্বাগত জানিয়েছে একজন সংসদ সদস্য উন কি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি চমৎকার চুক্তি করেছে এবং এর সাফল্য কামনা এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে চুক্তি করেছেন তা করতে পারলে এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার নিশ্চিত আনন্দিত হতেন।’ পার্বত্য চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিশ্বের দাতাগোষ্ঠী ওই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার সাহসী এবং বিচক্ষণতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চুক্তি করা সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশে বিএনপি নামক একটি (গণবিরোধী ও সন্ত্রাসী এবং শান্তিবিরোধী) দল এই চুক্তির বিরোধিতা করে বলেছিল যে, এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে দেশের একদশমাংশ ভারত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এই ১৭ বছরেও কোন ভূখ- ভারতভুক্ত হয়নি বরং বর্ডার বাউন্ডারি লাইন নিয়ে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি (১৯৭২) সহসাই বাস্তবায়নে ভারত আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমাদের ভূখ-ের সঙ্গে আরও সমতলভূমি যোগ হয়। ইতিমধ্যে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারে বাংলাদেশ প্রায় সমপরিমাণ বঙ্গোপসাগরের মালিকানা পেয়েছে। এছাড়া পার্বত্য এলাকায় জেলা জজ আদালত বসেছে। অর্থাৎ এতদিন সেখানে সরকারের সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কশ ছিল না। যা অর্জিত হয়েছে। এখন বিচার-আচার সেখানে বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক শুরু হয়েছে। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এখন আর বাংলাদেশে আশ্রয় পায় না। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়ার ভাষায় বিএনপির আমলে আমাদের বাংলাদেশে থাকতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগ এলে জেলে যেতে হয়। এখন আর ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র নেয়ার এই ভূখ- ব্যবহৃত হয় না। যা হয়েছিল ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান, যা এখন কোটে বিচারাধীন এবং তারেক রহমানসহ বিএনপি শীর্ষ নেতা ও কর্মকর্তারা আসামি। তবে সবচাইতে বড় সমস্যা ভূমি বণ্টন। পাহাড়ীদের যে ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে জিয়াউর রহমান সমতলের লোকদের বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে মূল পার্বত্য মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। এটাই সন্তু লারমার ক্ষোভের কারণ এবং তাই সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে। তবে আমরা মনে করি এসব সমস্যার সমাধান জরুরী। আমাদের বিশ্বাস বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যমনি তিনিই তার বাস্তবায়ন করবেন। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
×