ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাকপ্রতিবন্ধী বাতাসীর জীবন

তিস্তাপাড়ের অসহায় নারী- লড়াই করে বেঁচে থাকা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

তিস্তাপাড়ের অসহায় নারী- লড়াই করে বেঁচে থাকা

তাহমিন হক ববি ॥ জীবন থেমে থাকে না। আর সে জীবনের চাকা সচল রাখতে অবিরাম সেলাই মেশিনের চাকা ঘোরাচ্ছেন বাতাসী বেগম। পরিশ্রম করলেই ভাগ্যের চাকা ঘোরানো সম্ভব, তারই প্রমাণ দিলেন বাতাসী বেগম। বাতাসী বাকপ্রতিবন্ধী নারী। সে দশ হাতে একা সব সামলায়। অবিরাম লড়াই করে জীবনের সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীরাও আজ বিশ্বের সঙ্গে ছন্দ মেলাচ্ছে। নানা পেশায় সফলভাবে কাজ করছে তারা। বাংলাদেশের নারীর এই চলমান অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতে বড় সাফল্যের স্বপ্ন দেখে। নীলফামারী জেলার তিস্তাবিধৌত ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের ছাতনাই মাস্টারপাড়ার গ্রামের বাকপ্রতিবন্ধী বাতাসী বেগম। জন্ম থেকেই কথা বলতে পারে না। তার ওপর বিয়ের তিন মাসের মাথায় ফেলে রেখে স্বামী পালিয়ে যায়। হালিম মিয়া ও রহিমা বেগমের মেয়ে বাতাসী। ৫ বোন ২ ভাইয়ের মধ্যে বাতাসী চতুর্থ। বাতাসীদের জমিজিরাত, ঘরবাড়ি সবই গ্রাস করেছে তিস্তা নদী। একে একে ৯ বার নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে হয়েছে বাতাসীদের। ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে, যেখানেই বাড়ি করেছে তারা সেই বাড়িই ধসে যায় তিস্তা নদীতে। নদীর ভাঙ্গনে সর্বহারা হয়ে বাতাসীর বাবা-মা তিস্তার ডান তীর মাস্টারপাড়ার বাঁধে আশ্রয় নেয়। অভাব-অনটনের সংসার তাই ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা না করিয়ে কোনভাবে দুই মেয়ের বিয়ে দেন বাতাসীর বাবা-মা। আর বোবা মেয়ে বাতাসী দিন দিন বেড়ে ওঠে। বিয়ের বিষয়টি বাবা-মায়ের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। স্বাভাবিক দুই মেয়ের বিয়ের সময় যেখানে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে বাতাসী আবার বাকপ্রতিবন্ধী। বাবা-মায়ের এমন দুশ্চিতায় দিন কাটে। দিন, মাস, বছর গড়িয়ে বাতাসীর বয়সও কুড়ি হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন এক প্রতিবেশী প্রস্তাব নিয়ে আসে, তার ভাইয়ের স্ত্রী তিন সন্তান রেখে অন্যত্র চলে গেছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য তার ভাইয়ের আবার বিয়ে করার প্রয়োজন। তার ভাই যৌতুক ছাড়াই বাতাসীকে বিয়ে করতে রাজি। বাতাসীর বাবা-মা বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বাতাসী বিয়ে করতে রাজি হয় না। যার সঙ্গে বিয়ে সেই লোকটির পূর্বের স্ত্রী ও সন্তানের কথা বাতাসীর কাছে গোপন রেখেই তাকে অনেক বুঝিয়ে বিয়ের আয়োজন করা হয়। ২০০৯ সালের ঘটনা। কথা বলতে না পারা বাতাসীর বিয়ে হলো পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ভাউলাগঞ্জ গ্রামের একাব্বর হোসেনের সঙ্গে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাতাসী চলে যায় স্বামীর সংসারে। এখানে এসেও ধাক্কা খেল বাতাসী। স্বামীর ঘরে ঢুকে আগের স্ত্রীর তিন সন্তান দেখে বাতাসী কেঁদে ওঠে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওই তিন সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে বুকে জড়িয়ে নেয়। বিয়ের তিন মাসের মাথায় বাতাসী সন্তানসম্ভবা হয়। ছলচাতুরিতে স্বামী ওই অবস্থায় বাতাসীকে তার পিতা-মাতার কাছে রেখে ওই যে চলে যায় আর বাতাসীর খোঁজটি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে বাতাসী ফের বোঝা হয়ে ওঠে পিতা-মাতার সংসারে। এখানে বাতাসীর কোলজুড়ে আসে এক কন্যাসন্তান। এর পর বাতাসীর মাথায় বাজ পড়ে পিতাকে চিরতরে হারিয়ে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বাতাসীর বাবা মারা যায়। যখন কূলকিনারা হারিয়ে বাতাসী হা-হুতোশ করছিল তখনি ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনে এগিয়ে আসে পল্লীশ্রী নামের একটি বেসরকারী সংস্থা। সংস্থাটি তিস্তাপারের নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে বাতাসী। তাকে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয় এবং ১৫ দিনের সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে তার চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বাড়ি থেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি দূরে হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেয় বাতাসী। পল্লীশ্রীর পক্ষে বাতাসীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বাতাসীর কথা ভেবে স্থায়ীভাবে আয়ের পথ সৃষ্টির জন্য প্রত্যাশা জনসংগঠন, নারী উদ্যোক্তা দলের তৈরি করা শপিং ব্যাগ তৈরির কারখানায় বাতাসীর কর্মসংস্থানের পথ করে দেয়া হয়। সেখানেই বাতাসী কাজ করে প্রতিদিন আয় করছে। বর্তমানে বাতাসীর আয় দিনে ২শ’ থেকে ২শ’ ৫০ টাকা। এখানে বাকপ্রতিবন্ধী বাতাসী কাজ করছে আরও ১০ অসহায় নারীর সঙ্গে। এরা হলো সেলিনা বেগম, আলেয়া খাতুন, লিপি আক্তার, খোদেজা বেগম, রোজিনা আক্তার, ফাতেমা বেগম, কুলসুম বেগম, শিল্পী আক্তার, আজিদা বেগম এবং আরিফা বেগম। এদের এক সময় স্বামীর সংসারে অভাব-অনটনে দিন কাটত। আজ তারা প্রত্যেকেই তাদের ভাগ্যের চাকার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জানা গেল পল্লীশ্রীর মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৩৪৭ নারীকে গরু পালন, ছাগর পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, সাথী ফসল উৎপাদন, মিষ্টি ব্যবসা, ধান-চালের ব্যবসা, টেলারিং, মিনি গার্মেন্টস, ধান ভানা মেশিন, কার্টন তৈরি, হাতপাখা তৈরি, চিড়া-মুড়ি ব্যবসা ইত্যাদির কাজ করছে। ফলে তিস্তাবিধৌত এলাকায় অভাবকে জয় করার এক সুবাতাস বৈইছে। যে বাতাস বাতাসী বেগমকে সুখের ঠিকানায় নিয়ে এসেছে। এদিকে বাতাসীর আয়-উপার্জনের কথা জানতে পেরে স্বামী ছুটে আসে তার কাছে। সব ছেড়ে সে বাতাসীর সঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু বাতাসী বুঝতে পারে তার স্বামীর চালাকি। ঐ স্বামীকে নিয়ে সংসার করতে রাজি হয়নি বাতাসী। বাতাসী আজ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। এজন্য সে গ্রামের সমিতিতে সাপ্তাহিক সঞ্চয় করে। কোন অবস্থাতেই সে এই জমাকৃত অর্থ নষ্ট করতে চায় না। ইশারায় মেয়েকে দেখিয়ে বলে বড় হলে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় এই টাকা খরচ করবে সে। বাতাসীর মেয়ে আজ ৫ বছরে পা রেখেছে। তার নাম রাখা হয়েছে আলেয়া খাতুন। সে এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি । তবে আসছে নতুন বছরে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে বলে ইঙ্গিতে বোঝালেন বাতাসী। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বাতাসীর সিবিওতে সপ্তাহে ২০ টাকা হারে সঞ্চয় করে। বর্তমানে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৫ টাকা। বাতাসী বোঝে প্রতিবন্ধী হওয়ার কত কষ্ট? তাই সে মনে করে, সমাজে যারা এ ধরনের প্রতিবন্ধী আছে তাদের যদি কাজের ব্যবস্থা করে আয়ের সঙ্গে জড়িত করা যায় তারা কারও বোঝা হয়ে থাকবে না। ডিমলা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শামীম জাহিদ তালুকদার জানায়, প্রতিবন্ধী মেয়েরা মনের শক্তি ও বুদ্ধি খাটিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে সমাজে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পাশাপাশি তিস্তাপারের অসহায় নারী আজ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বাতাসীর প্রত্যাশা, সমাজে এমন কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি রয়েছেন যাদের একটু ভালবাসা ও সাহায্য-সহযোগিতায় একটি ভালমানের সেলাই মেশিন কিনতে পারলে বর্তমান কাজের পাশাপাশি সে নিজের বাড়িতে বসেও আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারত।
×